নিউজ ডেস্ক::
মায়ানমার সেনা বাহিনী কতৃক নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে সরকারি বেসরকারী সহযোগিতার ত্রাণ এখন কক্সবাজার শহরের সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতেও পৌছে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের জিনিস। মূলতঃ রোহিঙ্গারা সেসব ত্রাণ খুবই কম মূল্যে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর রোহিঙ্গাদের সব ত্রাণ বাজারে এনে বিপুল টাকার ব্যবসার জন্য ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারা ক্যাম্পের ভেতর থেকে কম মুল্যে সব নামী দামী ত্রাণ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্টদের দাবী রোহিঙ্গাদের কাছে এত বেশি পরিমান ত্রাণ মজুদ আছে তারা ত্রাণ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের উপর ঘুমাতে হয়। এদিকে প্রশাসন ও মনে করছে রোহিঙ্গাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমান ত্রাণ মজুদ থাকায় তারা ত্রাণ বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। সচেতন মহলের দাবী ত্রাণ পর্যাপ্ত থাকলে তা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় মানুষের মাঝে বিতরণ করা হউক।
১৩ জানুয়ারী শনিবার সকালে কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া এলাকায় এক গৃহিনীর বাড়িতে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের বেশ কিছু সামগ্রি নিয়ে আসেন আরেক মহিলা। সালেমা নামের সেই বিক্রেতা মহিলা নিজেও রোহিঙ্গা ১০/১২ বছর আগে মায়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসে এখন স্থায়ী ভাবে এখানেই থাকে, সেলাই কাজ করে ভালই আয় হয় তার। এখন সে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে বিভিন্ন ত্রাণের জিনিস এনে বাসা বাড়িতে বিক্রি করে বাড়তি আয় করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গৃহিনী মহিলা বলেন আমি ১৩০০ টাকা দিয়ে স্টিলের ২ টি ডেক্সি, ৬ টি প্লেইট,৬ টি গ্লাস,১২ টি চামচ,১ টি বড় চামচ কিনেছি। বিক্রেতা মহিলা দাম বলেছিল ২ হাজার আমি দরদাম করে ১৩০০ টাকায় নিয়েছি। একই সময় পশ্চিম টেকপাড়া এলাকায় আরেক বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে সেখানেই ৩টি কম্বল, ৫ কেজি ডাল, ১০ কেজি তেল বিক্রি করেছে সেই রোহিঙ্গা মহিলা তিনি ১২০০ টাকা দিয়ে এসব জিনিস কিনেছেন। পরে খবর নিয়ে শহরের পেশকার পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে গত ১ সপ্তাহের মধ্যে সেখানে অন্তত ২০টি বাড়িতে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের সামগ্রি কিনেছে।
এসময় শামসুন্নাহার নামের এক গৃহিনী বলেন আমাদের বাসা বাড়িতে এসব রোহিঙ্গাদের ত্রাণের সামগ্রি বিক্রি করতে আসে অনেকে সেখান থেকেই আমরা এসব জিনিস কিনেছি। এখানে অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের ত্রাণের জিনিস কিনছেন সাধারণ মানুষজন। ক্রয় করা জিনিসের মধ্যে আছে বিভিন্ন নামিদামী কোম্পানীর প্রসাধনী সামগ্রি,কম্বল, ডেক্সি, বাসন কোসন, বালতি, খাবার জিনিস, ডাল, আলু, লবন ইত্যাদি এমনকি অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তেরপলও নাকি কিনে এনেছে।
এদিকে শহরের সমিতি পাড়ার সিরাজুল করিম বলেন, এখানে রোহিঙ্গাদের ত্রানের জিনিসে ভরপুর হয়ে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের জিনিস আছে এবং প্রতিদিন সকাল বিকাল এখানে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের জিনিসের হাট বসে। সব দামিদামি জিনিস বিক্রি করে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। এরমধ্যে শিশু খাদ্য, ভিটামিন বিস্কুট, টিনজাত খাবার, ডাল, চাল ইত্যাদি এমনকি অনেকে ২/৩ বস্তা করে চাল কিনে নিয়ে আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। তিনি আরো বলেন ইতিমধ্যে সেসব রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কিনে এনে শহরের বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি করার জন্য বেশ কিছু সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে গেছে।
উখিয়ার সুজন সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, কোটবাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি বাজারে এখন রোহিঙ্গাদের ত্রাণের হাট বসে। তারা প্রকাশ্য বাজারে তেরপল নিয়ে বসে ত্রানের জিনিসপত্র বিক্রি করছে। এতে বাজারে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্ধেক মুল্যে মানুষ জিনিসপত্র কিনতে পারছে তাই রোহিঙ্গাদের আসার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে অনেকে। রোহিঙ্গারা ২ লিটার সয়াবিন তেলে বিক্রি করছে ৯০ টাকায়, আধা বস্তা চাল বিক্রি করছে ৭০০ টাকায়, ভাল স্টিলের বাসন কোসন বিক্রি করছে কম দামে। তাই অনেক মানুষ আছে সেগুলো কেনার জন্য বসে থাকে। তারা আবার সেগুলো হয়তো নিজেদের বাসাবাড়িতে ব্যবহার করছে না হলে প্রকৃত বাজার মুল্যে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের মালামাল কিনা নিয়ে কিছু প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া পর্যন্ত হয়েছিল। তিনি বলেন বর্তমানে সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে,সেখানে প্রায় ৯০টির মত দেশী বিদেশী এনজিও কাজ করছে তারা প্রতি নিয়ম রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিচ্ছে সে হিসাবে তাদের ত্রাণের কোন সমস্যা নেই। তাই বাড়তি ত্রাণ তারা বিক্রি করে দিচ্ছে। এটা রোধ করার জন্য ত্রাণ বিতরণে সমন্নয় করা দরকার। আর যদি কোন পচনশীল জিনিস থাকে তাহলে সেটা স্থানীয়দের মাঝে বন্টন করা যায়।
উখিয়ায় কর্মরত উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিক্রি করার ঘটনা অনেক আগের। তারা যে ত্রাণ বাইরে বিক্রি করছে এটা প্রকাশ্য বিষয়। আমরা সরজমিনে থাকি সেখানে দেখি রোহিঙ্গাদের বাসাবাড়িতে অনেক ত্রাণ আছে যা তারা ২ মাস ঘরে বসে খেতে পারবে । এর পরও আবার ও ত্রাণ দিচ্ছে তাহলে তারা এত ত্রাণ কি করবে তাই বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার রোহিঙ্গারাও বেশ চালাক তারা ঘরে বসে বাড়তি আয় ইনকামের জন্য লাইনে লাড়িয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে আর সেই সব ত্রাণ বাইরে বিক্রি করে দেয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি রোহিঙ্গাদের কারনে অনেক স্থানীয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ তাই অতিরিক্ত ত্রাণ থাকলে সে গুলো স্থানীয়দের মাঝে বিতরণ করা দরকার। এদিকে মোবাইল ফোনে কুতুপালং এর ৪ নং সেড এর মাঝি রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক বলেন অনেকের বাড়িতে ত্রাণের কারনে রাতে ঘুমাবার জায়গা নেই তাই বাধ্য হয়ে অনেকে ত্রাণ বিক্রি করে দিচ্ছে, তবে সবাই যে ত্রাণ বিক্রি করছে সেটা ও সঠিক নয়।
এব্যাপারে টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কমিশনার আবদুল কুদ্দুস বলেন, এখানে সব সময় বাজারে রোহিঙ্গাদের ত্রাণে ভরপুর থাকে বিশেষ করে চাল,ডাল,শিশু খাদ্য,বিভিন্ন তেরপল,টিন,পলিথিন,কাপড় ইত্যাদি,এখানে আবার দেখছি কিছু মানুষ আছে যারা আগে থেকেই রোহিঙ্গা এখন স্থায়ী হয়ে গেছে তারা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে সে সব জিনিস পত্র এনে বাড়তি দামে বাইরে বিক্রি করছে। ইদানিং তাদের দেখাদেখি অনেকে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তিনিও দাবী করেন সরকারের উচিত হবে রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত ত্রাণ না দিয়ে তাদের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় মানুষজনকে ত্রান সহায়তা করা।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়া উপজেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকতা বলেন গত কিছুদিন আগে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে ১ সপ্তাহর জন্য এনজিওদের নিষেধ করা হয়েছিল। পরে দেখি সেটা নিয়ে অনেক ভাল ভাল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে।
এব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিকারুজ্জামান বলেন আগে সর্বস্থরের মানুষজন যেভাবে ত্রাণ দিত এখন সেটা কমে এসেছে। তবে কর্মরত এনজিও গুলো এবং সরকারি ভাবে খাবার এবং আনুষাঙ্গিক সহযোগিতা অব্যাহত আছে,তবে ত্রাণ বিক্রির বিষয় টি সঠিক। এবিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ মাহিদুর রহমান বলেন অনেক কাঁচা জিনিস পত্র থাকে যা বিতরণ করতেই হয় আর প্রথম দিকে অনেক ত্রাণ এসেছে, এছাড়া এখন এনজিও সহ দেশি বিদেশী সংস্থার সহযোগিতা অব্যাহত আছে। সে কারনে রোহিঙ্গাদের মাঝে অতিরিক্ত ত্রাণ হয়ে গেছে। সে কারনে অনেকে ত্রাণ বিক্রির মত ঘটনা ঘটাচ্ছে। সুত্র: দৈনিক কক্সবাজার