বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মানবপাচারকারীরা মুক্তিপণ দাবি করছে বলে অভিযোগ তাদের স্বজনদের৷
কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার এ অভিযোগ করেছে বলে জানায় থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন৷
স্বজনরা জানান, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে মানবপাচারকারীদের হাত ধরে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া রওয়ানা হয়েছেন৷ এখন মানবপাচারকারীরা ওইসব রোহিঙ্গার পরিবারের সদস্যদের ফোন করে আরো অর্থ দাবি করছে৷ নতুবা তারা রোহিঙ্গাদের নৌকা তীরে না নিয়ে গিয়ে গভীর সমুদ্রেই ফেলে রেখে আসবে বলে হুমকি দিচ্ছে৷ কয়েকটি পরিবার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পেয়েছে বলেও দাবি করেছে৷
অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নানা সময়ে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তাদের অধিকাংশই এসেছে ২০১৭ সালে সন্ত্রাস দমনের নামে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর৷
বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে ফিরে গেলে আবারও নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হতে পারেন- এমন আতঙ্কে রোহিঙ্গা মুসলমানরা নিজ ভূমিতে ফিরতে রাজি হচ্ছে না৷ অন্যদিকে ক্যাম্পে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন যাপনে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন৷
মানবপাচারকারীরা এ অবস্থাকে পুঁজি করে উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের দক্ষিণ=পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে মালয়েশিয়া পাচার করে৷ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ছোট ছোট নৌকায় করে অজানা সমুদ্র পথে রওয়ানা হয় রোহিঙ্গারা৷
গত মার্চে নৌকায় করে মালয়েশিয়া রওয়ানা হয় ১৭ বছরের এক কিশোরী৷ তার ভাই বলেন, ‘‘সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে আমি সেটাও এখন জানি না৷
আমার বোন রওয়ানা হওয়ার এক মাস পর এক দালাল ফোন করে বলে, যদি আমি আমার বোনকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং মালয়েশিয়া ঢুকাতে চাই তবে আমাকে আরো এক লাখ টাকা দিতে হবে৷ তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগেই ঋণ করে দালালকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছি৷ এখন আবার টাকা চাইছে, আমরা কোথায় পাবো এত টাকা?’’
রয়টার্স এরকম ১২টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে, যাদের সবাই জানিয়েছে, দালালকে নতুন করে বাড়তি টাকা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের কারোই নেই৷
বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, মালয়েশিয়া উপকূলে শতাধিক রোহিঙ্গা সমুদ্রে নৌকায় ভাসছে৷ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অজুহাতে দেশটির সরকার তাদের তীরে ভেড়ার অনুমতি দিচ্ছে না৷
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারবে না৷
নৌকা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহে ২৬৯ রোহিঙ্গা সাঁতরে তীরে উঠলে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেপ্তার করে৷ তার আগে গত মাসে মালয়েশিয়ার ফিরিয়ে দেওয়া দুইটি নৌকা কয়েক সপ্তাহ সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়৷ প্রায় একশ রোহিঙ্গা অনাহারে মারা যায় বলেও দাবি করা হয়েছে৷ বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাকি ৩৯৬ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে৷ তারা দালালদের বিরুদ্ধে মারধর এবং খাবার ও পানির অভাবে অনেকে মারা গেছে বলে দাবি করেছে৷
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য দালালদের অত্যাচার আরো বেড়ে যাবে৷ সেই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যুও৷
মানবপাচারের বিরুদ্ধে কাজ করা দাতব্য সংস্থা ‘ইয়ং পাওয়ার ইন সোশাল অ্যাকশন’-এর প্রধান যিশু বড়ুয়া বলেন, ‘‘আমরা ১৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ৩০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি৷ দালালরা তাদের ফোন দিয়ে বলেছে, যদি স্বজনদের জীবিত দেখতে চায় তবে টাকা দিতে হবে৷ সেখানে আরো অনেক পরিবারের কাছে টাকা দাবি করে ফোন এসেছে৷’’
জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে এখনো কোনো অভিযোগ আসেনি বলে জানান পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন৷
কক্সবাজার থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই মানবপাচার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো৷’’
সমুদ্র শান্ত থাকায় এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার বেড়ে যায়৷ ইন্টারপোলের তথ্যানুযায়ী, মার্চ ও এপ্রিল- এই দুই মাসে মানবপাচার তিনগুণ বেড়ে গেছে৷ তবে এ বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা৷
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আইওএম-এর প্রতিবেদনেও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা পরিবার থেকে ‘বাড়তি অর্থ’ আদায়ের অভিযোগ উঠার কথা বলা হয়েছে৷ তবে বাড়তি অর্থ সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গাদের তীরে পৌঁছে দেওয়া নিশ্চয়তা দিতে পারছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না৷
বাংলাদেশ সরকার সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা পাচার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে৷ কোস্টগার্ড ২০১৯ সাল থেকে প্রায় সাড়ে সাতশ রোহিঙ্গাকে পাচার হওয়া থেকে রক্ষা করেছে৷
বাংলাদেশের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘‘মানবপাচার বন্ধে দালাল চক্রটিকে খুঁজে বের করতেই হবে৷’’
মোবিন নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, তার ১৭ বছরের ছেলেটি দুইমাস আগে মালয়েশিয়া রওয়ানা হয়৷
‘‘আমি তাকে যেতে বারণ করেছিলাম৷ বলেছিলাম, এ পথে অনেক বিপদ৷ কিন্তু সে লেখাপড়া করে জীবনে কিছু একটা করতে চায়৷ তাই ক্যাম্প ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছিল৷ জানি না তাকে আর দেখতে পাবো কিনা৷’’
সুত্র: DW (থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)