উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
আশির কাছাকাছি বয়স হোসেন শরীফ এই নিয়ে চতুর্থবার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তার কাছে বাড়ির নম্বর প্লেটসহ দলিলপত্র ছবি সবই আছে। সেই সঙ্গে আছে দু’দেশে আসা যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ মিলিশিয়াদের গণহত্যার মুখে তিন সন্তান নিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রথম পালিয়ে এসেছিলেন হোসেন শরীফ। বছরখানেক পর ফেরত গিয়ে আবার ১৯৯১ সালে আসতে হয়েছে পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে। ওই দফায় বাংলাদেশে ছিলেন তিন বছর।
গত ২৫ আগস্ট নতুন করে রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হয় জাতিগত নিধন। এবার নয় সন্তান আর নাতি-নাতনি নিয়ে আবার বাংলাদেশে আসেন তিনি। এখন আবার ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে হতাশ হোসেন শরীফ।
রাখাইনের অধিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে সপ্তাহখানেক আগে সমঝোতা বা অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে তাদের ফেরত নেয়া হবে। দুই মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও এতে বলা হয়েছে।
কিন্তু ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসার দাবি করে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। এছাড়া বারবার হত্যাযজ্ঞের মুখে পালিয়ে এসে আবার ফেরত গিয়ে একই পরিণতির মুখোমুখি হতে চান না তারা।
বৃটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা’র এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে আসে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের আকুতি। তারা টেকসই কোনো সমধান ছাড়া মিয়ানমার ফিরতে চান না। তারা চান নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নেয়া ফাতেমা বেগম এসেছেন খালি হাতে। তার ভাষ্যে প্রাণ বাঁচানোই ছিল তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য। তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র ছিল কিন্তু সব পুড়ে গেছে। আমরা জীবন নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। আমরা অত্যাচার, জুলুম সহ্য করতে না পেরেই চলে এসেছি, বাবা...।’
ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের সবারই মোটামুটি একই রকম বক্তব্য। তারা চান রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, সমান সুযোগ ও নাগরিক অধিকার এবং স্থায়ী শান্তি। এসব নিশ্চিত না হলে তারা আর রাখাইনে ফিরতে চান না।
ফাতেমা বেগম বলেন, তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরতে পারবেন মিয়ানমারের অধিবাসী যারা স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহী, অভিভাবকহীন এবং আদালতে স্বীকৃত বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শিশু।
ফিরতে হলে সবাইকে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য লাগবে নাগরিক পরিচয়পত্র, জাতীয় নিবন্ধন। আর আবাসস্থলের প্রমাণ করতে লাগবে বসবাসের ঠিকানা, ব্যবসা বা জমির দলিল, স্কুলের পরিচয়পত্র, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ইস্যুকরা কাগজপত্র।
রাখাইনে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নুরুল আমিন এখন বালুখালি ক্যাম্পের বাসিন্দা। এসেছেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। সঙ্গে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে। নুরুল আমিন আসার সময় হাতের কাছে থাকা সব কাগজপত্রই এনেছেন।
তবে নিজ দেশে ফেরার প্রশ্নে নুরুল আমিন জানান, তাদেরও কিছু শর্ত আছে। তিনি বলেন, ‘প্রথম শর্ত হলো- আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো অধিকার দিতে হবে। আর আমার যে জমিজমা, ব্যাবসা-প্রজেক্ট ছিল সেগুলো ফেরত দিতে হবে। আমরা চলে যাব। আমরা আমাদের দেশেই থাকতে চাই।’
জানা গেছে, ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে এই অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এরকম ব্যবস্থার মাধ্যমে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
চতুর্থবার পালি আসা হোসেন শরীফ, ‘আমরা আর কত কষ্ট করব। আর কতবার দুঃখ সহ্য করবো। আর ভালো লাগে না। মনে হয়, মরলে এখানেই মরব। আমাদের দেশ আমাদের দিলে, রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নিলে যাব, নইলে যাব না।’
দু’দেশের মধ্যেকার দলিলে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে যুক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর জানাচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো তারা এই দলিলের কপি পায়নি।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সংস্থাটির পক্ষে মোহাম্মেদ আবু আসকের বলেন, ‘তারা দেশহীন শরণার্থী। তারা কোন দেশের সেটি প্রমাণ করার মতো তথ্য প্রমাণ তাদের হাতে নেই। স্বাক্ষরিত অ্যারেঞ্জমেন্টের বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমরা চাচ্ছি- টেকসই সমাধান।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে তিন-চারবারও বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আবার ফেরত গেছেন। তাদের নাগরিকত্বসহ মূল সমস্যার সমাধান আমরা চাই। আমরা চাই না বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক।’
এই পরিস্থিতিতে সব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যে জটিল প্রক্রিয়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে- শর্ত যাই থাকুক এই ব্যবস্থা হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সূচনামাত্র।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই একটি লোকের যখন ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, বলপূর্বক বিতাড়িত করে, তখন তার কাগজপত্র নেয়ার কোনো সময়-সুযোগ থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘যাদের কাগজপত্র আছে তাদের আছে। বাকিদের ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকার ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় দফা, তৃতীয় দফা আলাপ-আলোচনা করবে।’