মিয়ানমারের সামরিক জান্তাঘনিষ্ঠ চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নোটিসে এ তথ্য জানানো হয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তাঘনিষ্ঠ চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নোটিসে এ তথ্য জানানো হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠিয়ে তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ট্রাম্পঘনিষ্ঠ কূটনীতির একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিছুদিন আগেই ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে একাধিক চিঠি পাঠান। সেই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারকেও একই চিঠি দেয়া হয়। জবাবে মিন অং হ্লাইং একাধিক পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে ট্রাম্পের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, তার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ট্রাম্পের পাঠানো চিঠিকে মিয়ানমারের শীর্ষ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জান্তার প্রতি প্রথম আনুষ্ঠানিক ‘স্বীকৃতি’ হিসেবেও বিবেচনা করেছেন।
জান্তাঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ আন্দোলনকে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা দুর্বল করে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, আরাকান আর্মি, কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং অন্য বেশকিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যেন জান্তার আর্থিক ও সামরিক জোগান বন্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে সামরিক জান্তা পুনরায় অস্ত্র, প্রযুক্তি ও তহবিল সংগ্রহে সুবিধা পাবে, যা মাঠের যুদ্ধে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলতে পারে। জাস্টিস ফর মিয়ানমার এক বিবৃতিতে জানায়, এ সিদ্ধান্ত যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে। এটি মিয়ানমারে জান্তার সহিংসতার প্রতি একধরনের পরোক্ষ বৈধতা।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিন অং হ্লাইং নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র থেকে সরে আসা, সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু পশ্চিমা দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে চার প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর থেকে এ নিষেধাজ্ঞা তুলেছে, তারা সবাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে কেটি সার্ভিসেস অ্যান্ড লজিস্টিকস, মিয়ানমার কেমিক্যাল অ্যান্ড মেশিনারি কোম্পানি, সানট্যাক টেকনোলজিস এবং ব্যবসায়ী টিন লাট মিন। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি নোটিসে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। হোয়াইট হাউজও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
২০২২ সালে কেটি সার্ভিসেস অ্যান্ড লজিস্টিকস এবং এর সিইও জনাথন মিও কিয়াউ থাউংকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ইয়াঙ্গুন বন্দরের ইজারা নেয়ার অভিযোগে, যা একটি সামরিক মালিকানাধীন কোম্পানি থেকে বার্ষিক ৩ মিলিয়ন ডলারে নেয়া হয়। নিউইয়র্ক টাইমস ও জাস্টিস ফর মিয়ানমারের অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ইউরোপীয় বিমান, ফরাসি নজরদারি প্রযুক্তি এবং ইতালীয় অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে জান্তাকে সহায়তা করেছেন। যদিও তিনি অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবে মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে এক দশকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন।
একইভাবে মিয়ানমার কেমিক্যাল অ্যান্ড মেশিনারি কোম্পানির মালিক আউং হ্লাইং উ ২০২২ সালে নিষিদ্ধ হন। ইউক্রেন ও সার্বিয়া থেকে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান আমদানির মাধ্যমে তিনি জান্তাকে সহায়তা করেন। ২০১৭ সালে তাকে ইউক্রেন মিয়ানমারে সম্মানসূচক কনসাল নিয়োগ দিয়েছিল। তার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি করা হয় বিটিআর-৪ এবং এমএমটি-৪০-এর মতো উন্নত অস্ত্র।
সানট্যাক টেকনোলজিসের মালিক সিট তাইন অং-কেও ২০২২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি সাবেক বনমন্ত্রী অং ফোনের ছেলে। কাঠ ব্যবসা থেকে উঠে এসে তিনি এখন জান্তার জন্য অস্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহের অন্যতম মুখ্য ব্যক্তি। ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপ থেকে অস্ত্র আমদানি করে সানট্যাক গ্রুপের অধীনে অস্ত্র উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। তিনি ইয়াতানারপন এভিয়েশন সাপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছেন জান্তাকে।
চতুর্থ ব্যক্তি টিন লাট মিন, যার নাম ২০২৪ সালে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত হয়েছিল। তার স্বামী থেইন উইন জ অ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী, যিনি জ্বালানি, রত্ন খনন, টেলিকম ও কাঠ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। টিন লাট মিনের নামে থাকা কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই সরাসরি জান্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের দুই সন্তানও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন।