জ্যাসন ববিয়েন ::
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পরিচ্ছন্নতা চালানোর সময় শান্তিতে নোবেলজয়ী সংস্থা ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’র একদল কর্মী এক মাস বয়সী কুকুরছানাটি উদ্ধার করেছিলেন। সেটিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে ‘মানবতাবাদের’ প্রতীক হয়ে উঠেছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর পাশে দাঁড়াতে চলমান ব্যাপক বিস্তৃত মানবিক কর্মযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার। তবে স্থানীয়দের কাছে কক্সবাজার পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুও। ৭৫ মাইল বিস্তৃত অখণ্ড বালুকাময় উপকূলরেখায় ‘পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত’ এটি।
সৈকত পরিচ্ছন্নতার কাজে মাসে একবার বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী কর্মী এখানে একসঙ্গে কাজ করতে এসে কক্সবাজারের দুই রূপেরই দেখা পান। গত বছরের নভেম্বরে এমনই এক পরিচ্ছন্নতাকর্ম চালানোর সময় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) একদল কর্মী এক মাস বয়সী এক কুকুরছানা উদ্ধার করেন। সেই থেকে সেটির নাম রাখা হয় ‘ফক্সট্রট’।
নিউজিল্যান্ডের নাগরিক ও ডব্লিউএফপি কমিউনিকেশন অফিসার জেমা স্নোডন বললেন, ‘হুট করেই কুকুরছানাটি চোখে পড়ল আমাদের। তারপর সে পিছু নিতে শুরু করল। আমরা ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। চেয়েছিলাম, ও যেন ওর মায়ের কাছেই ফিরে যায়। কিন্তু ও আমাদের পিছু ছাড়ল না।’
ফক্সট্রট ছিল রোগা ও পরিশ্রান্ত। ভীষণ রকম পানিশূন্যতায় ভুগছিল। নিজের মাকে খুঁজে বের করার বদলে স্নোডনের পিছু নেওয়ার দিকেই মনোযোগ ছিল ওর। ফলে স্নোডন ওকে ডব্লিউএফপি কম্পাউন্ডে নিজের অফিসে নিয়ে আসেন।
স্নোডন বলেন, ‘রাতে আমি ওকে ওখানেই রেখে দিলাম। বিশ্বাস করুন, আমরা কেউ ভাবিনি ও বেঁচে যাবে। কারণ একেবারেই পুঁচকে এ রকম একটা কুকুরছানা কী করে মাকে ছাড়া বাঁচবে? পরের দিন অফিসে এসে দেখি, সে চারপাশে আনন্দে ছুটোছুটি করছে। তারপর থেকে কম্পাউন্ডজুড়ে ছুটে বেড়ায় সে।’
স্নোডনের শুশ্রূষায় নিজের শক্তি ফিরে পেয়েছে ফক্সট্রন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডব্লিউএফপির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের আলোচনায় ওকে এখন অনলাইন ভিডিওতে ভয়েসওভার দিতে (কুকুরের কণ্ঠে) দেখা যায়!
কম্পিউটারের মনিটরে ভেসে ওঠা এক ভিডিওতে আন্তরিকভাবে ফক্সট্রট ঘোষণা দেয়, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের কর্মযজ্ঞের আমিও একটা অংশ। আমার নিজের একটা আইডি ব্যাজ রয়েছে! আপনারা কি জানেন, ৮ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন?’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করার অনুমতি নেই। মূলত জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ওপর তাদের নিজেদের ও পরিবারের খাদ্য নির্ভর করে। বাংলাদেশে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৬৯০ জন রোহিঙ্গাকে প্রতি মাসে ৮ হাজার মেট্রিক টন চাল-সহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা দেয় ডব্লিউএফপি।
বলে রাখা ভালো, চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছে এই সংস্থা।
কক্সবাজারে ডব্লিউএফপির অফিসে ফক্সট্রটের আগমনকে অবশ্য শুরুতে সবাই ভালোভাবে নেননি। ‘কুকুর আমার মোটেও ভালো লাগে না,— বলেন সংস্থাটির কক্সবাজার কর্মযজ্ঞে জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কাজ করা বিন্তা বাজাহা। তিনি মূলত গাম্বিয়ার মানুষ হলেও বসবাস কানাডায়। ফক্সট্রটকে যে সময় ‘উদ্ধার’ করা হয়, সেই সৈকত পরিচ্ছন্নতাকর্মে তিনিও ছিলেন। তবে কুকুরছানাকে অফিসে নিয়ে আসার আইডিয়াটি তার মনে ধরেনি।
তিনি বলেন, ‘ফক্সট্রটকে অফিসে এনে তারা কী করার কথা ভাবছিলেন, আমার কোনো ধারণাই ছিল না। স্রেফ মনে হয়েছিল, আরে, অফিসে কুকুরছানার কাজ কী?’
মানুষের অফিসে কুকুরছানা কী কাজে লাগবে— সেটি নিশ্চয় একটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারে। ‘ও হ্যালো বলতে আর এর-ওর পায়ে যৎসামান্য কামড় বসাতে পছন্দ করে’— হাসতে হাসতে বলেন কক্সবাজারে ডব্লিউএফপির ডেপুটি ইমার্জেন্সি কোঅর্ডিনেটর জেফ কাপুর। নিজেকে ভারতীয়-কেনিয়ান পরিচয় দেওয়া জেফ বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাজ্যে। তিনি জানান, তাদের অফিস কম্পাউন্ডে একটা বড় উপহার হয়ে উঠেছে ফক্সট্রট। জেফ কাপুরের ভাষায়— ‘আমরা ওকে ভালোবাসি। আর ও আমাদের সঙ্গেই থাকে।’
ফক্সট্রট যখন এখানে আসে, কতদিন টিকতে পারবে, সে ব্যাপারে কেউ অবশ্য নিশ্চিত ছিল না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো অসুস্থ হয়ে প্রায় মরতেই বসেছিল সে।
স্নোডন বলেন, ‘কক্সবাজারে কোনো পশুচিকিৎসক নেই। তার মানে, আমরা ওকে টিকা দিতে পারিনি। ও পারভোভাইরাসে আক্রান্ত কি না এ নিয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কেননা টিকা না দেওয়া কুকুরছানাদের ক্ষেত্রে পারভোভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রায় ৯০ শতাংশ।’
আসলে কক্সবাজারে একজনই পশুচিকিৎসক রয়েছেন। তবে তিনি শুধু ছাগল, ভেড়া ও গবাদিপশুর এবং কালেভদ্রে ঘোড়ার চিকিৎসা করেন। ফলে সহকর্মীদের ওপর ভরসা করে, ফক্সট্রটের জন্য আইভি ফ্লুইড খুঁজে আনার চেষ্টা করেন স্নোডন। কয়েকজন নার্সেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। আর এভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে ফক্সট্রট। এদিকে ওর প্রাণ বাঁচাতে ‘কুকুর আমার মোটেও ভালো লাগে না’ বলা বাজাহাও খেটেছেন খুব।
বাজাহা বলেন, ‘এক শুক্রবারে, এখানকার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জেমা (স্নোডন) আমাকে ফার্স্ট-এইড কিট এনে দিতে ফোন করলেন। আমি উঠে গিয়ে দেখলাম, ওর অবস্থা কী। এরপর ওর প্রতি মায়া জেগে ওঠল। আমি কুকুর পছন্দ করি বা না করি, তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না; সে আসলে এই পরিবারেরই একটা অংশ।’ এত মাস পরও তিনি সেই ঘটনা ভেবে এখনও অবাক হন।
এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (৮ মার্চ) বাজাহাকে তার সাহায্যের দাম ফিরিয়ে দিয়েছে ফক্সট্রট। মাঠে বেড়াতে যাওয়ার সময় সে ডব্লিউএফপির একটা ক্যাপ মাথায় পরে। মানবতাবাদী কাজে ন্যস্ত থাকা পশুর একটি পরিচয় এটি। জেন্ডার ইস্যুতে বাজাহানের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানাতে সেই ক্যাপের বদলে নারী দিবসের বিশেষ বেগুনিরঙা ক্যাপ পরেছিল সে।
বাজাহা বলেন, ‘ওর একটা ইনস্টাগ্রাম পেজ আছে, যেন রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে পারে। তাই ভালোবাসি বা না-বাসি, ফক্সট্রটকে একটা সম্পদ হিসেবেই গণ্য করি আমি।’
এদিকে স্নোডন জানান, ‘মাসকট’ গুণের পাশাপাশি প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতেও দক্ষ ফক্সট্রট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরটিতে যখন ওর কাজ থাকে না, তখন ওকে ইনস্টাগ্রামে (Humanitarian_Pup) এবং এমনকি কখনো কখনো টুইটারেও খুঁজে পাওয়া যাবে।
জ্যাসন ববিয়েন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর (এনপিআর) সায়েন্স ডেস্কের গ্লোবাল হেল্থ এন্ড ডেভেলপমেন্ট করেসপন্ডেন্ট।