ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২০/০২/২০২৩ ৯:২০ এএম

সেন্টমার্টিনের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ছোট পেঁয়াজ। এক সময় সেন্টমার্টিনের বাজারে ঝাঁজালো স্বাদের এই পেঁয়াজের জন্য ছিল আলাদা দোকান। এমনকি দ্বীপের প্রতিটি দোকানে কিছু না থাকলেও ছোট পেঁয়াজ থাকতো সব সময়। এখন পুরো দ্বীপ খুঁজে ছোট জাতের লাল এই পেঁয়াজ পাওয়া দুষ্কর। অল্প সংখ্যক যা পাওয়া যায় তার দামও আকাশচুম্বি। আঁটিতে বাঁধা ছোট জাতের এই পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকা।

ছোট জাতের এই পেঁয়াজের উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো- কটেজ, রিসোর্ট ও স্থাপনা নির্মাণ। যে জায়গায় পেঁয়াজ ও নানা শাক-সবজি উৎপাদিত হতো সে জায়গায় এখন বিলাসবহুল স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। আবার এসব কটেজ ও হোটেলের ময়লা দূষণ করছে পরিবেশ। এসব কারণে উৎপাদন কমে এসেছে ছোট পেঁয়াজের।

এক সময় টেকনাফ-উখিয়াসহ কক্সবাজার জেলার প্রতিটি পরিবারে মাছ-মাংস রান্নার জন্য সেন্টমার্টিনের ছোট জাতের লাল পেঁয়াজ ছিল প্রধান উপাদান। কেউ সেন্টমার্টিন গেলে সবার আগে খুঁজতেন এই ছোট জাতের লাল পেঁয়াজ। অনেক পরিবার এই পেঁয়াজ মজুত করে রাখতেন। এখন জেলা তো দূরের কথা, সেন্টমার্টিন দ্বীপের লোকজনও এই পেঁয়াজ দিয়ে রসনা বিলাস করতে পারছেন না। তারাও এখন অন্য জাতের দেশি-বিদেশি পেঁয়াজ দিয়ে রান্নার চাহিদা মেটান।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, পেঁয়াজ যারা উৎপাদন করতেন তারা এখন অন্য পেশায় ফিরে গেছেন। কারণ যেসব জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতেন সেখানে এখন নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। জমির শ্রেণী পরিবর্তন হওয়ায় ক্রমাগতভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পেঁয়াজ উৎপাদন।

দ্বীপের বাসিন্দা রফিক উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর আগেও সেন্টমার্টিনে লাল পেঁয়াজ বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকায়। সেখানে এই পেঁয়াজ এখন ২০০ টাকা কেজি। তাও পাওয়া দুষ্কর। দ্বীপের মানুষ টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ দেশের কোথাও গেলে হাতে করে লাল পেঁয়াজ নিয়ে যেতেন স্বজনদের বাড়িতে। আবার কেউ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এলে তারাও হাতে করে লাল পেঁয়াজ কিনে ফিরতেন। এখন দ্বীপের কোথাও লাল পেঁয়াজ নেই। অবশ্য শখের বশে এখনও কিছু লোক বাপ দাদার পুরনো পেশাকে ধরে রাখতে ঝাঁজালো ছোট জাতের লাল পেঁয়াজের চাষ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার উৎপাদিত পেঁয়াজের তুলনায় সেন্টমার্টিনের ছোট পেঁয়াজের স্বাদ ও ঝাঁজ অন্যতম।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের আব্দুল মালেক বলেন, দ্বীপে আশঙ্কাজনকহারে হোটেল–মোটেলসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে চাষের জমি কমে এসেছে, সেই সাথে লাল পেঁয়াজের আবাদও কমে গেছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ৭ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে চাষের জমি ছিল ৮৬১ একর। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬০০ একর জমিতে ধান, তরমুজ, মরিচ ও টমেটোসহ অন্যান্য ফসলের চাষ হতো। আর ১৫ একর জমিতে চাষ হতো লাল পেঁয়াজের। গত দুই দশকে চাষের ৫৯৫ একর জমি বিক্রি হয়েছে। সেসব জমিতে গড়ে উঠেছে ১৫০টির বেশি হোটেল–রিসোর্ট। গত মৌসুমে ধানসহ শীতকালীন সবজির চাষ কমেছে ৭৭ শতাংশ। লাল পেঁয়াজের চাষ হয়েছিল অল্প জমিতে।

দ্বীপের কটেজ মালিক সেলিম উদ্দিন বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে জায়গার দামও। পেঁয়াজ চাষে লাভ সীমিত। তাই চাষের জমিতে হোটেল-রেস্তোরাঁ বানিয়ে পর্যটন মৌসুমে ব্যবসা করা হচ্ছে।

পেঁয়াজ চাষি শফিক আহমেদ বলেন, আজ থেকে দুই বছর আগে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করতাম। ওই জমিতে এখন ঘরবাড়ি-দোকানপাট হয়েছে। ফলে এই পেঁয়াজ চাষ করতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে দ্বীপের লোকজন। ছোট জাতের লাল পেঁয়াজের চাষ দেশের অন্য কোথাও হয় কি না আমার জানা নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, প্রায় শতবছর আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে ছোট জাতের লাল পেঁয়াজের বীজ নিয়ে আসা হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সেই থেকে এই পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে আসছে। কিন্তু এখন পেঁয়াজ উৎপাদন করতে সেন্টমার্টিনে জায়গার অভাব। কোথাও পেঁয়াজ চাষ করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা নেই। অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে ঐতিহ্যবাহী এই ঝাঁজালো ছোট পেঁয়াজের বিলুপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, পেঁয়াজ চাষি অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ হোটেলে চাকরি করছেন। কেউ পর্যটন ব্যবসা শুরু করেছেন। অনেকে আবার ইজিবাইক বা ভ্যানচালক। তবে অধিকাংশই জেলে শ্রমিক হয়ে সাগরে মৎস্য আহরণ করছেন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ছোট জাতের ঐতিহ্যবাহী লাল পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত করতে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দ্বীপের যত্রতত্র হোটেল–মোটেলসহ অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন।

পাঠকের মতামত