ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৯/০৩/২০২৩ ৮:৩১ পিএম

তাসমিদা জোহার, যিনি ভারতীয় রোহিঙ্গা নারীদের মধ্য থেকে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ছিল একটা যুদ্ধের অনুভূতি।

“খবরের শিরোনাম হতে পেরে আমি খুশি। একই সঙ্গে আবার দুঃখ লাগছে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারার জন্য আমি খুশি। তবে এটা আমার জন্য ভয়েরও কারণ। নয়া দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত একটি পার্কে বসে আল জাজিরাকে এসব কথা বলেন তাসমিদা।”

“আমি এ জন্য দুঃখবোধ করছি অনেক রোহিঙ্গা নারী আছেন, যারা শিক্ষিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন না।”

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনবাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা নিজ ভূমি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী ভারত এবং বাংলাদেশে অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। এসব রোহিঙ্গাদের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে বাস এবং ত্রিপল দিয়ে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের মধ্যে অনেকে ২০১৭ সালের আগে পালিয়ে গেছে। এ সংখ্যার মধ্যে মাত্র এক হাজার রোহিঙ্গা ভারতের দিল্লিতে বসবাস করছে।

২০১৪ সালে ভারতে সরকার প্রধান হিসেবে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গারা ঘৃণা এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত বছর ভারত সরকার জানায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত তাদের আশ্রয় শিবিরে রাখা হবে।

১৯৫১ সালে জাতিসংঘে শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে ভারত স্বাক্ষর করেনি। এছাড়া ১৯৬৭ সালের শরণার্থী বিষয় নিরাপত্তা আইনে তারা স্বাক্ষর করেনি।

২৬ বছর বয়সী জোহার জানান, তিনি দুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মিয়ানমারে সে তাসমিন ফাতিমা নামে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার বাবা-মা শিগগিরই তার নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।

সে জানায়, মিয়ানমারে থাকতেই তার নাম পরিবর্তন করা হয়। এমন নাম রাখা হয় যাতে বোঝা যায় সে একজন বৌদ্ধ। এর কারণ সেখানে বৌদ্ধ না হলে স্কুলে যাওয়া যায় না এবং শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যদি জানতে পারে যে একজন রোহিঙ্গার একটি ব্যবসা আছে, তাহলে তাকে ‘আক্রমণ ও কারাগারে পাঠানো হত।’

আল জাজিরাকে সে জানায়, তার বাবা আমানুল্লাহ জোহার একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ফল এবং সবজি রপ্তানি করতেন। এ ঘটার জানার পরই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনা হয়।

জোহার বলেন, মিয়ানমারের স্কুলগুলোতে সব সময় তাদের বৈষ্যমের শিকার হতে হয়েছে।

“যদি আপনি বার্মার স্কুলগুলোতে প্রথম স্থান অর্জন করেন, তবে তারা আপনাকে পুরষ্কার দেয় না যদি প্রথম স্থান অধিকারী বৌদ্ধ না হয়।”

বৌদ্ধ শিশুদের রোল নম্বর থাকত প্রথম দিকে। এছাড়া আমাদের শ্রেণিকক্ষে উচ্চ শব্দে কথা বলা যেত না। সব সময় ক্লাসে পেছনে বসতে হত। স্কুলে হিজাব পড়ে গেলে আমাদের নির্যাতন করা হত।

অত্যাচার বেড়ে গেলে ২০০৫ সালে তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যায়। প্রথমে একটি গাড়িতে করে তারা সীমান্তে পৌঁছায়। এরপর ট্রলারে করে কক্সবাজার আসে।

এখানে এসে তাদের আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। তখন তার বাবার বয়স ৬৪ বছর। সে বয়সে তাকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। তার মা আমিনা খাতুন (৫৬) একটি স্থানীয় কারখানায় কাজ শুরু করেন।

যদিও জোহার মিয়ানমারে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিল, তবুও তাকে আবার প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করতে হয়েছিল। কিন্তু নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোহিঙ্গা এবং বার্মিজ ভাষা ছাড়াও বাংলা, উর্দু এবং ইংরেজি শিখতে শুরু করেন যা তিনি আগে থেকেই জানতেন। ভারতে আসার পর তিনি হিন্দিও শিখেছেন।

২০১২ সালে বাংলাদেশিদের দ্বারা হামলার শিকার হয়। সে সময়ে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনার পর তার পরিবার সিদ্ধান্ত নিল ভারতে চলে যাওয়ার। প্রথমে তার পরিবার হরিয়ানায় পাড়ি জামায়। কিন্তু সেখানে শিক্ষা অর্জন করার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা রাজধানী নয়া দিল্লিতে চলে আসে। সেখানে কালিন্ডা কুঞ্জ ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।

জোহার বলেন, তিনি ভারতে এসে অনেক বাধা পেয়েছিলেন। তিনি ভয় পেয়েছিলেন কারণ তিনি একজন রোহিঙ্গা ছিলেন। আবার তিনি হিন্দিও জানতেন না।

“আমি চাইনি যে আমার পরিচয় স্কুলে সমস্ত শিশুদের কাছে প্রকাশ হোক। কারণ আমি কোনো বিশেষ সহায়তা চাইনি। এছাড়া কেউ আমাকে সন্ত্রাসী কিংবা অন্য নামে ডাকুক তাও চাইনি।“

তাসমিদা বাসে করে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করত। সে যখন স্কুল-কলেজে যেত তখন তার মা ভিশন চিন্তায় পড়ে যেতেন। মেয়ে কখন স্কুল-কলেজ থেকে ফিরবে তার জন্য তিনি রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করা এই রোহিঙ্গা নারী বলেন, “অনেকবার, আমি বাসে সিট পাইনি। কিন্তু আমরা যা মুখোমুখি হয়েছিলাম তার তুলনায় এটি কিছুই ছিল না। কষ্টের পরে আপনি যে সাফল্য অর্জন করেন তা অন্যরকম মনে হয়।“

ভারতে বসবাসের জন্য যখন জোহার বাংলাদেশ ছাড়ে যখন সে তার কমিউনিটির মধ্যে ভয় দেখেছিল। কারণ অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মনে করে তারা যদি তাদের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য বাহিরে পাঠায় তাহলে সরকার তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, অথবা যে কেউ তাকে অপহরণ করতে পারে। কিংবা ধর্ষণের শিকারও হতে পারে। যেগুলো বার্মাতে ঘটত।

অনেক প্রতিবেশী তার বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাকে পড়াশুনা করিয়ে কী করবেন, যদি তার কিছু হয়ে যায়?

তবে তাসমিদা তাদের কথায় কান দেননি। এখন সে সফল হওয়ার পর অনেকের মনোভাব বদলেছে। এখন অনেক রোহিঙ্গা পরিবার তার সন্তানদের পড়াশুনা করার জন্য স্কুলে পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ আবার বাড়িতে টিউটরও রাখছে।

আরও পড়ুন:

ইরানের ঐতিহ্যবাহী নওরোজ উৎসবের যত অজানা কথা
রাসূল সা. ও তার সাহাবীরা যেভাবে রোজা পালন শুরু করেছিলেন
ভারতের হীরা শিল্পে যেভাবে বিপ্লব ঘটছে
ইউএনএইচসিআর-এর ডুয়োলিঙ্গ প্রোগ্রামের আওতায় অনগ্রসর এবং উচ্চ শিক্ষা অর্জনে যাদের আগ্রহ আছে এমন ২৫ জন শরণার্থী শিক্ষার্থীকে নির্বাচন করা হয়েছে। যাদের মধ্যে জোহার একজন। ডুয়োলিঙ্গ প্রোগ্রামের আওতায় জোহার এখন কাডানার উইলফ্রিড লরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে যাবে।

তাসমিদা স্বপ্ন তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হবেন। তিনি নারী শিক্ষা এবং নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চান। এছাড়া যেসক নারীরা অল্প বয়সে পাচারের শিকার হয় তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা।

‘আমার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা জানানো। কারণ দিনকে দিন আমরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি।

পাঠকের মতামত