মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্বস্তি বিরাজ করছে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার ইতিমধ্যে রাখাইন জুড়ে খানা ও লোক সংখ্যা যাচাই করণ কাজ শুরু করেছে। ২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী যে সব খানায় বর্ণিত জনসংখ্যা অনুপস্থিত পাবে তাদের রাখাইন প্রদেশের সুযোগ দেওয়া হবে না। খানা হালনাগাদ ও যাচাই করণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে ইতিমধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার ফেরত গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নতুনভাবে বাংলাদেশ আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে রাখাইনে ফিরে যাবার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তা আর সম্ভব হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের সুপারিশের প্রেক্ষিতে রাখাইন বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হচ্ছে বলে জানা গেছে।
উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া মংডু উত্তরের বলি বাজার থানার পোয়াখালী গ্রামের মোহাম্মদ উল্লাহ’র ছেলে সাবেক উল্লাহ (১৪) জানায়, সে ১৭ মার্চ তুমব্রু সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেখানকার নাইং চং অ্যালে ড স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে লেখা পড়া করলেও ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে স্কুল বন্ধ রয়েছে বলে সে জানান। দুই মাস পূর্বে মা-বাবা সহ পরিবারের অন্যান্যরা বাংলাদেশে চলে আসে কিন্তু সে অপরাপর স্বজনদের সাথে বাড়িতে থেকে যায়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন গ্রামে মিলিটারি আসলেও এখন শান্ত বলে সে জানায়। সে আরো জানায় মা-বাবা সহ পরিবারের অন্যদের কিভাবে নিয়ে যাওয়া যায় সে জন্য স্বজনরা পাঠিয়েছে তাকে। কারণ বর্তমানে সেখানে খানা ও সদস্য পুনঃ যাচাইয়ের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের ছবি উঠানোর কাজ চলছে। এ যাচাই করণে যারা বাদ পড়বে তারা দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। কুতুপালং বস্তিতে নতুন আসা মংডুর গৌজবিল এলাকা মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিন, বালুখালী বস্তি আলি জোহার, লাল মোহাম্মদ, করিম উল্লাহসহ আরো অনেক রোহিঙ্গা সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানায়। তবে রাখাইন শুমারি যাচাই কাজ চলাই সেখানে বাদ পড়ে যাওয়া অস্বস্তিতে তারা। কারণ রাখাইন এবারের খানা শুমারিতে যাদের পাওয়া যাবে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে সরকার চিন্তা করছে বলে তারা জানতে পেরেছে। তবে বাংলাদেশের শুমারি তাদের দেশে কোন কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে টানাপোড়নে রয়েছে রোহিঙ্গারা। বলি বাজার থানার পোয়াখালী গ্রামের শফিউল্লাহ পার্শ্ববর্তী খিয়ারী পাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহীম, ছৈয়দ উল্লাহ জানায়, প্রায় ২০দিন পূর্বে ২/৩শ লোক দেশে ফিরে গেছে। তাদের আর বাংলাদেশে চলে আসার সম্ভাবনা নেই বলে জানায় তারা। কারণ নিজ দেশে আত্মীয় স্বজন, ঘরবাড়ি, জায়গা জমি নিয়ে অনেক ভালো থাকে। আর বাংলাদেশে ছোট ঝুপড়িতে অস্বস্তিকর অবস্থায় নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তাদের মতে এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চেয়ে নিজ দেশেই অনেক ভালো। এ ছাড়াও গত দুই দিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন তদন্ত কমিশনের সদস্যরা কুতুপালংসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন কালে জানান ইতিমধ্যে ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কক্সবাজারের উপ পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান, গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিকদের হালনাগাদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান। একই সাথে সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে নতুন ভাবে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়াদের ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত বছর কক্সবাজার সহ ৬ জেলায় রোহিঙ্গা শুমারি হলেও এবার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর ও চকরিয়া উপজেলায় শুমারির কাজ চলে বলে তিনি জানান। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সরকার উচ্চ পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। শুনেছি মিয়ানমার সরকারের গঠিত আরাকান উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফিরে যাওয়ায় উত্তম বলে তিনি জানান।
অধিকর দরিদ্র কবলিত, অনুন্নত মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সার্বিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সমস্যবলি চিহ্নিত পূর্বক তা সমাধানে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষে গঠিত রাখাইন উপদেষ্টা কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। কমিশনের সুপারিশে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমন্বয় সাধনের সুপারিশ বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় শিবির ও অন্যান্য এলাকায় রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা প্রদান, সহিংসতা কবলিত এলাকা গুলোতে মানবাধিকার ও সংবাদ কর্মীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করে উত্তর রাখাইনের আক্রান্ত এলাকায় উত্থাপিত অভিযোগগুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ দানের আহবান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে নাগরিকত্ব, অবাধ চলাচল সহ সকল অধিকার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার দ্বার খুলে দেওয়া মাধ্যমে পরস্পর বিদ্বেষপূর্ণ রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেওয়াই হবে প্রথম পদক্ষেপ। সরকার অবশ্য সুপারিশগুলো শীঘ্রই বাস্তবায়নের অগ্রগতি দৃষ্টমান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বলে এ.এফ.পি, দা মিঝিমা ও অন্যান্য গনমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।