মধ্যবয়সী আক্তার হোসেনের হাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রসহ একটি ফাইল। যাত্রীবেশে চড়েছেন ঢাকাগামী তিতাস কমিউটার ট্রেনে। ট্রেনে তাঁর চলাফেরায় সন্দেহ হলো রেলওয়ে গোয়েন্দা পুলিশের। ট্রেন থেকে তাঁকে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো।
বারবার জিজ্ঞেস করার পরও আক্তার জানান, তাঁর সঙ্গে কোনো অবৈধ পণ্য নেই। সন্দেহ তাতেও দূর হয় না পুলিশের। শেষ পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে আক্তারের হাতে থাকা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের ফাইলে পাওয়া যায় ২০০ পিস ইয়াবা। গত ২০ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ রেলস্টেশনে এ ঘটনা ঘটে।
অভিযান পরিচালনাকারী রেল পুলিশের এক কর্মকর্তা পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, চেহারার সঙ্গে শরীরের গড়ন একদমই মিলছিল না। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, তাঁরা ‘গর্ভবতী’। সন্দেহবশত ট্রেনে থাকা দুই নারীর দেহ তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় বিশেষ কায়দায় শরীরে তারের মতো পেঁচিয়ে রাখা গাঁজা। সম্প্রতি আখাউড়া রেলস্টেশনে লোকাল ট্রেনে এই ঘটনা ঘটে।
এভাবেই অভিনব সব কৌশলে দেশের বিভিন্ন সীমান্তপথে আনা ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার করা হচ্ছে ট্রেনে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠছেন মাদক কারবারিরা। এই মাদক পাচারে নারী ও শিশুদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাদক পাচার করতে গিয়ে কেউ সাজছেন রোগী, কেউ বা ‘গর্ভবতী’। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, বেনাপোল, আশুগঞ্জসহ পূর্ব রেলের বিভিন্ন স্টেশনে পাচারকারীদের দেখা মিলছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিন সীমান্তবর্তী উপজেলা কসবা, আখাউড়া ও বিজয়নগর হয়ে আসা মাদক ট্রেনে পাচার করা হয়। আখাউড়া রেলওয়ে থানার তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে (নভেম্বর) এই থানার অধীন জেলার ১১টি রেলস্টেশন এলাকায় বিভিন্ন ট্রেনে ২৫০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে ২১ জন চোরাকারবারিকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ৫১ কেজি ৫০০ গ্রাম গাঁজা, এক হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা। এ ছাড়া ট্রেন থেকে ছয় কেজি ৭০০ গ্রাম গাঁজা, ৯ বোতল ইস্কফ উদ্ধার করা হয়। মোট মামলা করা হয়েছে ১৮টি। সর্বশেষ গত সোমবার ভোররাতে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসে অভিযান চালিয়ে যাত্রীবেশী দুই কারবারির কাছ থেকে ১২ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে সিলেট গোয়েন্দা পুলিশ। দুটি ট্রলিতে থাকা এসব গাঁজা উদ্ধার করে দুই মাদক কারবারিকে আখাউড়া রেলওয়ে থানায় সোপর্দ করা হয়। গাঁজাসহ আটক ব্যক্তিরা হলেন মো. আয়াত আলী ও মো. সাগর। তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় বিভিন্ন সীমান্ত ছাড়াও মায়ানমার সীমান্তপথেও ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দেশে ঢুকছে। সূত্র জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার জল ও স্থল সীমান্ত, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কম হলেও ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ইয়াবা আনছেন পাচারকারীরা। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, ফুলতী, লম্বাশিয়া, রেজু আমতলী, চেরারকুল, সোনাইছড়ি, উত্তরপাড়া, বাইশফাঁড়ির বিভিন্ন পথে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক আসছে। এ ছাড়া টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নাফ নদীর খুরের মুখ, ঘোলারপাড়া, মাঝেরপাড়া সৈকত, হারিয়াখালী, কাটাবনিয়া, মহেশখালিয়াপাড়া সৈকত, নোয়াখালিয়াপাড়া দিয়েও আনা হচ্ছে মাদকের চালান। চালান আনা হচ্ছে একই উপজেলার খোনকারপাড়া, শামলাপুর, মাথাভাঙ্গা, বড়ডেইল, উখিয়ার ইনানি, হিমছড়ি দরিয়ানগরসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার মায়ানমার সীমান্তবর্তী বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা দিয়ে পাহাড়, নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে বাংলাদেশে মাদক পাচার করে আনা হচ্ছে। এরপর তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। কক্সবাজার থেকে সড়ক ও নৌপথের পাশাপাশি রেলপথে ইয়াবা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক মাস ধরে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ইয়াবাসহ মাদকের বড় বড় চালান পাচার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা থানার পুলিশের কক্সবাজার রেলস্টেশনে কোনো অফিস না থাকায় তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এই সুযোগে এই রেলস্টেশনও কারবারের বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামের দুটি বিরতিহীন (শুধু চট্টগ্রাম স্টেশনে থামে) ট্রেন চলাচল করে। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে সৈকত ও প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে করে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাদক কারবারিরা ট্রেনে ইয়াবা বহনের সময় পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ইয়াবা এক জায়গায় রাখেন, নিজেরা অন্য জায়গায় বসেন।
ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ট্রেনে করে পাচার করা হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। রেলওয়ে পুলিশ জানায়, এসব মাদক পাচারে একাধিক ‘লাইনম্যান’ জড়িত রয়েছেন। মাদক আনা হয় সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন সীমান্তপথে মাদক কারবারের বিষয়ে আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেনে মাদক পাচারকারীরা অনেক কৌশলী। পাচারকাজে তারা নারী ও শিশুদের ব্যবহার করে। এমনভাবে নারীরা ট্রেনে থাকে যে অনেক সময় বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে যে তারা মাদক কারবারি। তারা পুলিশের চোখকে নানাভাবে ফাঁকি দেয়।’
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর বেনাপোল রেলস্টেশনে খুলনা-মোংলা-বেনাপোল রুটের বেতনা এক্সপ্রেসে তল্লাশি চালিয়ে একটি ব্যাগ থেকে ২.৭৬০ কেজি কোকেন এবং এক কেজি ৬৯২ গ্রাম হেরোইন জব্দ করেছে বিজিবি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ট্রেনে অভিনব কায়দায় ইয়াবা পাচারকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চার হাজার ৮৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ সুলতান প্রামাণিককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ১ ও ১০। সুলতান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, দীর্ঘদিন ধরে কমলাপুর রেলস্টেশন ও আশপাশে তিনি ইয়াবা সরবরাহ করছিলেন।
অভিযান পরিচালনাকারী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর মাদক পাচারের রুট পরিবর্তন করেছে পাচারকারীচক্র। সীমান্ত এলাকায় বিকল্প পথ বেছে নেওয়ার পাশাপাশি এখন ট্রেনেও তারা মাদক পাচার করছে ব্যাপক হারে। মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ ও আইসের পাশাপাশি হেরোইন ও কোকেনও পাচার করছে তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে লাগেজ স্ক্যানার, যাত্রী তল্লাশির সুযোগ না থাকায় ট্রেনে মাদক পাচার বাড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার অবশ্য এরই মধ্যে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘বর্তমানে ট্রেনের মাধ্যমে ব্যাপক হারে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনে উঠতে না পারায় কোনো ইয়াবা কারবারিকে গ্রেপ্তার করতে পারি না। সুত্র,কালেরকন্ঠ