উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪/০২/২০২৩ ১০:৫২ এএম

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়, জাগোনিউজ::
টাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টায় ‘হরকাতুল জিহাদ’ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা-ফাইল ছবি
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয় ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পাঁচ বছর পেরিয়ে এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। কিন্তু মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যেন বর্তমানে ‘বিষফোড়া’হিসেবে রূপ নিচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা। জড়িয়ে পড়ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও। আর রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়াতে তৎপর জঙ্গি সংগঠনগুলোও।

এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়াতে সাহায্য-সহযোগিতার আড়ালে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। সংগঠনটি ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পাঁচ বছর পর্যন্ত গোপনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে আর্থিক সহায়তা দিলেও তা প্রকাশ পায় গত ২৮ জানুয়ারি।

রোহিঙ্গাদের সমন্বয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলার পরিকল্পাও নেয় সংগঠনটি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে দেশে বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে নতুন করে হরকাতুল জিহাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া।

সম্প্রতি হরকাতুল জিহাদের ছয় সদস্যকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানতে পারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রণবীর ওরফে মাসুদ (৪৪) ও তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানের বিষয়টি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।

সিটিটিসি জানায়, রোহিঙ্গাদের টাকা দিতে হুজি নেতা ফখরুল ইসলাম ও তার ছেলে সাইফুল ইসলাম অন্য সদস্যদের নিয়ে একাধিকবার কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। তারা রোহিঙ্গাদের সংগঠনে সম্পৃক্ত করতে মাঠে নামেন। ওই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে তাদের বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা অনুদান দেন। টাকার লোভে হুজি নেতা ফখরুলের নেতৃত্বে দেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল রোহিঙ্গাদের।

হুজি নেতা ফখরুল ইসলাম ১৯৮৮ সালে আফগান যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানে যান। এরপর তিনি আফগানিস্তানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭, এলএমজি ও রকেট লঞ্চার চালাতে শেখেন। ওই সময়ে ফখরুল আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন বলে জানা গেছে।

সিটিটিসির তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সদস্য রিক্রুট করা। তেমন হুজির বড় টার্গেট ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদস্য রিক্রুট করা। এ জন্য তারা গত পাঁচ বছরে নির্দিষ্ট কিছু রোহিঙ্গাকে সাহায্যের নামে মোটা অংকের টাকা দিয়েছে। রিমান্ডে থাকা হুজি নেতাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া রোহিঙ্গাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। সেসব রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই চলছে। এ বিষয়ে কাজ করছে একাধিক গোয়েন্দা।

হুজিকে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন ফখরুল
সিটিটিসির জঙ্গি কার্যক্রমবিরোধী অপারেশন চলমান থাকায় হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নানসহ একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হন। এর পরে হরকাতুল জিহাদ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে এসে ফখরুল ইসলাম জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নতুন সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। হরকাতুল জিহাদের সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি ও তার ছেলে সাইফুল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা ও যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ। এ জঙ্গি সংগঠন মাথা চাড়া দিলে আবারও হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।

অন্যদিকে, গত ২৩ জানুয়ারি ভোরে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন গহীন বনাঞ্চল এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রণবীর এবং সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশারকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের অবস্থান শনাক্তের পর অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এ সময় জঙ্গিরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। একপর্যায়ে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে পালিয়ে গেলে সেখান থেকে রণবীর ও তার সহযোগী বাশারকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নগদ টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৫৫ জন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে এ জঙ্গি সংগঠনকে সহায়তা এবং সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে জানা যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে সামরিক শাখার প্রধানসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।

রোহিঙ্গাক্যাম্প এলাকা থেকে গ্রেফতার সন্ত্রাসীরা-ফাইল ছবিরোহিঙ্গাক্যাম্প এলাকা থেকে গ্রেফতার সন্ত্রাসীরা-ফাইল ছবি

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া ও তারা যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে পরিবেশ এবং সামাজিক ভারসাম্যহীনতার বোঝা বহন করছে বাংলাদেশ। যদি এ সংকট দ্রুত সমাধান না করা যায় তাহলে এ অঞ্চল ও এর বাইরে নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি হতে পারে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সরকার।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার যদি শিগগির সমাধান না হয় তাহলে এরা (রোহিঙ্গা) ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিস্টদের ইজি প্রে (আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সহজ শিকার) হবে। আমরা বলবো না তারা প্রে হয়ে গেছে, আমরা সম্ভাবনার কথা বলছি। সম্ভাবনার আড়ালে আমরা দু-একটা ঘটনাও দেখছি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান সেটিরই ইঙ্গিত বহন করে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ইয়াবার টাকা ভাগাভাগির জন্যই রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তাদের মূলোৎপাটন করা যায়নি।

সম্প্রতি র‌্যাব মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, দেশের রোহিঙ্গারা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশ পালিয়ে যাচ্ছে। তবে এগুলো প্রতিরোধে কাজ করছে র‌্যাব। যতই চেষ্টা করুক তাদের কোনো ধরনের অপকর্ম করতে দেওয়া হবে না। তাদের ব্যাপারে সবসময়ই সতর্ক র‌্যাব।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, দেশবিরোধী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রোহিঙ্গাদের দলে টানতে চাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। বিষয়টি মাথায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যে কোনো জঙ্গি সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্যে থাকে সদস্য রিক্রুট করা। এ জন্য হুজি চেয়েছিল আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাদের দলে ভেড়াতে। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গাদের ১০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা করেছে হুজি। এ টাকা কোথা থেকে এলো, কারা দিয়েছে, কীভাবে দেওয়া হয়েছে সেসব নিয়ে কাজ চলমান।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, কোনো জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গাদের তাদের দলে ভেড়াতে পারবে না। আমরা কিছু নাম পেয়েছি, তালিকা করে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। : সৌজন্যে: জাগো নিউজ

পাঠকের মতামত

মিয়ানমারে সংঘাত/টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢুকল আরও ৯ বিজিপি সদস্য

মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ...