প্রকাশিত: ০৩/০৫/২০২২ ৯:০৭ পিএম

সালাহ উদ্দিন জসিম ::
জোর যার নিয়ন্ত্রণ তার— এই স্টাইলে চলছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতারা জড়িয়ে গেছেন নিজস্ব বলয় গড়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। দলের সিনিয়র নেতাদের নামে প্রকাশ্যে বিষদগার, নেতাকর্মীদের সভার মধ্যে মারধর কিংবা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের রীতিনীতি, আদর্শ, শিষ্টাচারের প্রসঙ্গ তুলে দায়িত্বশীলরা বলছেন এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, হবে।

জানা যায়, নিজস্ব বলয়ের স্বার্থে দুর্দিনের ত্যাগী কর্মীটিকেও ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করেন না অনেকেই। এমনকি নেতাদের মারধর, হামলা-মামলার নজিরও সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকাশ্য সভায় দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশ্যেও তীর্যক মন্তব্য ছোড়েন জেলা পর্যায়ের নেতারা। যে কারণে চেইন অব কমান্ডের অবস্থাও নাজুক।

তবে টানা ১২ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকায় দলের এই অবস্থাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে, ৭ মে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ায় ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা ও দুর্দিনের এই আওয়ামী লীগের নেতা গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ নেতার রোষানলে পড়েছেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ‘কাজী ভাই (কাজী আজাদ জাহান শামীম) খুব জনপ্রিয়, সৎ ও আদর্শবান নেতা। তার সততা ও স্পষ্টবাদিতাই কাল হলো।’

২২ এপ্রিল কক্সবাজারের টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে দলীয় সভায় পিটিয়েছেন সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুর রহমান বদি। ওই মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তারা বলছেন, বিষয়টি দেখে মনে হলো- ‘জোর যার নিয়ন্ত্রণ তার’। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা নিশ্চিত করেছেন।

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণের শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী হাবিবুর রহমান হাবু মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকা-৪ আসনের টিম সদস্যদের পিটিয়েছেন। এ নিয়ে টিমের প্রধান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দিলীপ রায় শাখা সভাপতি-সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন।

এদিকে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে কুমিল্লার বরুড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সম্মাননা অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছিমুল আলম চৌধুরী এমপিকে তার সামনেই ‘রাজাকারপুত্র ও দেশদ্রোহীর ভাতিজা’ আখ্যা দিয়ে উৎখাতের ঘোষণা দিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এ এন এম মইনুল ইসলাম। এ নিয়ে এলাকায় দুই গ্রুপের থমথমে অবস্থা ছিল। একজন এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকে ‘রাজাকারপুত্র ও দেশদ্রোহীর ভাতিজা’ বলে প্রকাশ্য সভায় অপদস্থ করার ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে দাবি করেছেন দলের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে বেশ সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিছুদিন পরে বরুড়া পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর হকও এ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন।

গেলো বছরের ১৪ জুন মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের সমর্থকরা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপকমিটির সদস্য এবং ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেনের গাড়িবহরে হামলা করে। সেসময় তার সঙ্গে তার বৃদ্ধ বাবা-মাও গাড়িতে ছিলেন। এ নিয়ে সারাদেশের সাবেক ছাত্রলীগের নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। যদিও ফলাফল কিছুই হয়নি।

১২ এপ্রিল ২০২২ কুমিল্লার লাকসামে নিজ বাড়িতে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপকমিটির সদস্য দেলোয়ার হোসেন ফারুকের ছেলের আকিকার অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও ফরিদপুরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপি প্রকাশ্য বক্তৃতায় যা তা ভাষায় কটুক্তি করেন। মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের প্রেডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমের বলয় নিয়ে তো খোদ দলীয় সভাপতির সামনে তাদের ত্রিমুখী বাহাস হয়।

নোয়াখালীতে ইকরামুল করিম চৌধুরী এমপি ও বসুরহাট পৌরমেয়র মির্জা আবদুল কাদের যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন। দুজনেই নানা সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়েও তীর্যক মন্তব্যও করেন। রাজনৈতিক পাড়ায় গল্প আছে- ‘নোয়াখালীতে ইকরাম ও ফেনীতে নিজাম- এরাই দেন সকল কাজের আঞ্জাম।’ স্থানীয়রা বলছেন, তাদের নৈতিক ও অনৈতিক সব কাজই মুখ বুজে সহ্য করেন নেতাকর্মীরা। মুখ খুললেই নেমে আসে খড়গ।

এভাবে সারাদেশে আওয়ামী লীগে ‘জোর যার নিয়ন্ত্রণ তার’ অবস্থা চলছে বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতাদের। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এরকম ঘটনা দলকে বিব্রত করে ঠিক। কিন্তু জোর যার দল তার, বিষয়টি এমন নয়। এসব বিষয়ে আমরা আমাদের সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি। দল সব সময় নেতাকর্মীদের পক্ষে, ক্ষমতাবানদের নয়।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জোর যার নিয়ন্ত্রণ তার, বিষয়টি তা নয়। সবার বিষয়ে সাংগঠনিক বিধি ব্যবস্থা একই রকম এবং অভিন্ন। আগামী ৭ মে আমাদের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আছে। সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে।’

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘জোর যার নিয়ন্ত্রণ তার— এরকম কিছু নয়। আওয়ামী লীগ টানা ১২ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। সে কারণে হয়তো অনেক জায়গায় অনেকেই নিজেদের বেশি ক্ষমতাবান মনে করে কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। এদের বিষয়ে আমরা সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। পটিয়াতে যারা আওয়ামী লীগ নেতাদের মারধর করেছে, ২৯ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। আমরা বদির বিরুদ্ধেও মামলা দিতে বলেছি, মামলা দিলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘এরকম দু’একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা দলকে বিব্রত করে এটা সত্য। তবে এটার মানে এই নয় যে, যার ক্ষমতা বেশি দল তার পক্ষে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন কিছু ঘটনা দেখছি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগে কেউই দলীয় গঠনতন্ত্রের রীতিনীতির ঊর্ধ্বে নয়। গঠনতন্ত্র সবচেয়ে শক্তিশালী। কেউ ব্যক্তিগতভাবে যতই ক্ষমতা দেখাক না কেন, দলের নিয়মনীতি ও আদর্শের কাছে কোনো দম্ভ টিকে থাকে না। সীমালঙ্ঘনকারীকে যেমন আল্লাহ পছন্দ করেন না, দলীয়ভাবেও তাকে এক সময়ে নিয়মনীতির মধ্যে আসতেই হবে। কেউ সীমালঙ্ঘন করলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটিই দলের নিয়ম।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। নিজের দম্ভ ও প্রতিপত্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করে— এটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন ও শেখ হাসিনার সংগঠনের দীর্ঘ সাত দশকের রীতিনীতি, সংস্কৃতি, আদর্শ ও শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। এগুলো যারা করে, তারা কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। তাদের ব্যাপারে নিশ্চয় দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সুত্র : জাগো নিউজ

পাঠকের মতামত

পুলিশ থেকে বাঁচতে জীবনটাই দিলেন সিএনজিচালক

গ্রামের চন্দনাইশে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে ...

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চলন্ত সিএনজিতে সিলিন্ডার বি’স্ফোরণ, চালক নিহত

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চন্দনাইশ এলাকায় চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুনে দগ্ধ হয়ে ...