জসিম মাহমুদ,টেকনাফ::
টেকনাফের উল্টো পাশে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আর মাঝখানে নাফনদী বিভক্ত করেছেন মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে। নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও কোনো না কোন ভাবেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে করে এক হাজারের বেশি জেলে পরিবারে অভাব-অনটনে দুর্দিন চলছেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিস্ট জেলে পরিবারের লোকজন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া ও দুপুরে টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া নাফনদী সংলগ্ন দুটি এলাকায় গিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক জেলেদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।
ওই সময় দেখা যায়, নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বিভিন্ন ঘাটে খালী নৌকাগুলো নোঙর করে রাখা হয়েছে। আর অন্যদিকে, বেড়িবাঁধের দল বেঁেধ কয়েকজন জেলে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। এসময় কথা হয় শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার বড় ফাঁদপাতা (বিহিঙ্গি) জেলে মোজাফর আহম্মদ (৫০) এ সঙ্গে।
তিনি বলেন, ১১ বছর বয়স থেকে তিনি নাফনদীতে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছেন। তার বাবা মারা যাবার পর থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব পড়ে তার উপর। র্দীঘ ২৭ বছর ধরে মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ১৩জনের সংসার চালাতে হচ্ছে । তারমধ্যে দুই ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়াও করাচ্ছেন। কিন্তু এখন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় পরিবারের খাবার যোগান দিতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
একই এলাকার ভাসা জালের জেলে এজাহার মিয়া বলেন, নাফনদী দিয়ে রোহিঙ্গা আসছে বলে আমাদের মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে তিন মাস ধরে । বিকল্প কোন কাজও করতে পারছি না। তার উপর সরকার আমাদের কোন ধরনের সাহার্য্য ও ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। অথচ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহযোগিতা দিয়ে জামাই আদরে রাখা হচ্ছে। আমরা কি দেশের নাগরিক নয় ? আমাদের ঘরের বাচ্ছারা অধিকাংশ সময় উপাস থাকছে। তারপরও কেন আমাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে চুরি-ডাকাতি করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না আমাদের।রোহিঙ্গাদের জন্য মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও প্রতিদিন নাফনদী দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকছে।
মাছ ব্যবসায়ী কোরবান আলী বলেন, এলাকার কিছু জেলেকে বছরের শুরুতে দাদনে টাকা দেওয়া হয়েছিল মৌসুমে মাছের বিপরীতে । তারাও এখন মাছ দিতে পারছে না। প্রতি বছর মাছ শুটকি ব্যবসায় ও শুটকি তৈরি করে সংসার চালাতাম। এখন সেটিও করতে পারছি না নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় । এখান থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে শুটকি উৎপাদন হলেও এ বছর শুটকির মাঁচাগুলো খালী পড়ে আছে।
টেকনাফ পৌরসভা জালিয়াপাড়ার বড় ফাঁদপাতা (বিহিঙ্গি) জাল সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ উসমান বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। মাছ ধরতে না পারায় জেলে পরিবারগুলোতে এখন চলছে দুর্দিন। তাই জেলেদের কথা চিন্তা করে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার টেকনাফ পৌরসভা, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম সংলগ্ন এ নাফনদীর অবস্থান।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা পারাপারকে কেন্দ্র করে নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখায় স্থানীয় হাটবাজারের মাছ সংকট দেখা দিয়েছে। নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নিবাহে চলত এমন পরিবারগুলোর দূরবস্থা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, নাফনদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও জেলেদের কোন ধরনের সরকারি ভাবে সহায়তার ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন এখানকার জেলে পরিবারগুলো। স্থানীয় প্রশাসন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ করতে নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ করেছে গত ২৫ আগস্ট থেকে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি বহাল থাকবে।
উপজেলা জ্যৈষ্ট মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, পুরো উপজেলায় নিবন্ধিত মাছ ধরার ১ হাজার ৮৫৫টি নৌকা থাকলেও জেলের সংখ্যা হলো ৭ হাজার ৮৮৩জন। তারমধ্যে নাফনদীতে মাছ ধরে প্রায় ছয় শতাধিক নৌকায় এক হাজার ১৮৬জন জেলে রয়েছেন।তিনি আরও বলেন, মাছ ধরা বন্ধ থাকা জেলেদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সংশ্লিস্ট কতৃপক্ষে কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফ-২-বিজিবির উপ অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার বলেন, এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য। কার্যত অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, জেলেদের একটি অংশ এখন রোহিঙ্গাদের পারাপারের ব্যবসায় লেগে পড়েছেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিকী বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু নৌকার মাঝি, মালিক ও দালাল চক্রের সদস্যরা রোহিঙ্গা পারাপার করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে পাঁচশতাধিক দালালকে অবৈধ ভাবে রোহিঙ্গা পারাপারের জড়িত থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়েছে ।