
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বিরুদ্ধে গত ৯ বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৩টির মতো প্রশ্নবিদ্ধ জঙ্গি নাটকের অভিযোগ রয়েছে। ফলে পুলিশের এসব অভিযান বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিল। যখন কোনো স্থানে জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করা হতো, তখনই পুলিশকে নিয়ে মানুষ হাসিঠাট্টা করত। অভিযানের পর পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। কিন্তু অভিযান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারত না। কেউ যদি এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতেনও, পরে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো।
এখন অতীতের এ বদনাম ঘুচিয়ে আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাস মোকাবিলায় পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটকে (এটিইউ) শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিএমপির একটি সূত্র জানিয়েছে, সিটিটিসিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চিন্তা রয়েছে। বিশেষায়িত ইউনিটটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জঙ্গি নাটকে ব্যস্ত ছিল। ফলে এ ইউনিটের কার্যক্রম ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে এটিইউর একটি ইউনিট ডিএমপিতে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ রয়েছে পুলিশের। শিগগির এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আওয়ামী আমলে জঙ্গি দমনের নামে নাটক সাজানো সিটিটিসির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধÑএ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইজিপি বাহারুল আলম পুলিশ সদর দপ্তরে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এরপর তিনি আমার দেশকে জানান, ‘এটিইউকে আরো বেশি শক্তিশালী করা হবে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা আমার দেশকে জানান, পুলিশের যেসব বিভাগ রয়েছে, সেসব বিভাগে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এতে সংস্থা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের আগস্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে নিয়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ ব্যুরো’ নামে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের সুপারিশ করে। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাবনা আকারে সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। নানা পর্যালোচনার পর ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির সিটিটিসি গঠন করা হয়।
সূত্র জানায়, এ বাহিনীতে কাউন্টার সন্ত্রাস বিভাগ, তদন্ত বিভাগ, সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ, ট্রান্সন্যাশনাল অপরাধ বিভাগ, হিউম্যান ট্রাফিকিং ও ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু একে শুধু জঙ্গি দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান ছিলেন ওই সময় ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। পরে তিনি পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কথিত জঙ্গি অভিযানের পর তিনি নানা কথা একসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে জানাতেন। এতে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হতো।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতনের পর গাঢাকা দেন মনিরুল। জানা গেছে, সে সময় তিনি ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি ভারতের আগরতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে সেখানেই বসবাস করছেন। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার অভিযোগে প্রায় একডজন মামলা রয়েছে।
সিটিটিসির প্রশ্নবিদ্ধ যত অভিযান
সিটিটিসি গত ৯ বছরে ৫৩টি জঙ্গি অভিযান চালিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সবকটি অভিযানই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে একটি হলো ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনায় কথিত জঙ্গি অভিযান। এ অভিযানে দুজনকে হত্যা করা হয়। বলা হয়, চারজন আত্মসমর্পণ করেছেন।
ইউনিটটি সাংবাদিকদের জানিয়েছিল, আত্মসমর্পণকারীরা হচ্ছেন রূপনগরে নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী শিলা ও তার সন্তান এবং মুসার স্ত্রী তৃষা ও তার সন্তান। মেজর জাহিদের স্ত্রী ও মেয়ে ছিলেন এখানে। প্রথমে দুজন আত্মসমর্পণ করে। তারা দুজনই শিশু। এরপর আরো তিনজন বাকি থেকে গিয়েছিল। তারা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। ওই তিনজনের মধ্যেও একজন শিশু ছিল। সুমনের স্ত্রী হঠাৎ করে বেরিয়ে আসার কথা বলেন। শিশু মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। তার গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা ছিল। তাতে তাজা গ্রেনেড ছিল। পুলিশ তাকে ওই ভেস্ট পরে না আসার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি ভেতরে গিয়ে আবার বেরিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে সুইসাইড ভেস্টের সুইচ ধরে টান দেন এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গে থাকা শিশুটি গুরুতর আহত হয়। পুলিশ ওই শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এরপরও ভেতরে একটি ছেলে ছিল। তাকে আত্মসমর্পণের অনুরোধে কাজ না হলে পুলিশ ভেতরে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপর সে গুলি করতে শুরু করে। তার কাছে গ্রেনেড ছিল। সেগুলো ছুড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তার অবস্থান লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করলে ভেতরে সে গুলিবিদ্ধ হয়। সেখানে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়িতে কথিত জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক ঘণ্টার ওই অভিযানে ৯ তরুণ নিহত হন। ওই ঘটনায় সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও মিরপুর জোনের তৎকালীন এসি জসিম উদ্দিন মোল্লাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এটিইউকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ
আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য পুলিশের অ্যান্ট্রি টেরোরিজম ইউনিটকে (এটিইউ) শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এই ইউনিটটি গঠন করা হয়। তবে কার্যক্রমে আসে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। এই শাখায় ৬০০-এর বেশি জনবল রয়েছে। ইউনিটটিতে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন অতিরিক্ত আইজিপি।
সূত্র জানায়, এই ইউনিটে আরো জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ বিভাগ। বিশেষ করে সাইবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আলাদা বিভাগ খুলে এর কার্যক্রমকে আরো বেগবান করা হবে। দক্ষতা বৃদ্ধিতে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য এ ইউনিটের সদস্যদের আমেরিকা, ব্রিটেন ও কানাডায় পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে দক্ষ কর্মকর্তাদের এই বিভাগে পদায়নের চেষ্টা করছে পুলিশ, যাতে ইউনিটের কার্যক্রম আরো বেশি বেগবান হয়।
এটিইউর নবনিযুক্ত প্রধান রেজাউল করীম আমার দেশকে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে এটিইউ কাজ শুরু করেছে, যেন অতীতের মতো কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়। এখন সাইবার প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ। এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে আমাদের সংশ্লিষ্ট ইউনিট কাজ করছে।
এই ইউনিটের জনবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দক্ষ জনবল দরকার। এখন যারা রয়েছেন, তাদের দক্ষ করতে বিদেশে পাঠানো হবে। সন্ত্রাস দমন প্রসঙ্গে রেজাউল করীম বলেন, শুধু দেশের মধ্যেই নয়, আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাস দমনেও আমাদের কার্যক্রম ও নজরদারি অব্যাহত থাকবে। সুত্র, আমারদেশ

পাঠকের মতামত