উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩০/১০/২০২২ ৭:৪৩ এএম
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ / ছবি : ওবাইদুল হক চৌধুরী

স্লিপার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কাজ। জানা গিয়েছে, প্রকল্পের দোহাজারী-চকরিয়া অংশে রেলপথ নির্মাণকাজের জন্য প্রতিদিন ৪৬১টি স্লিপার প্রয়োজন। কিন্তু দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৮২টি স্লিপার। সংকটের কারণে এ অংশের প্রায় ৬৮ কিলোমিটার রেলপথ (ট্র্যাক) বসানোর কাজে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রয়োজনের অর্ধেক স্লিপারও সরবরাহ করতে পারেনি প্রকল্পের ঠিকাদার।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ডুয়াল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথের নির্মাণকাজ দুটি অংশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথম অংশ (লট-১) দোহাজারী-চকরিয়ার কাজ বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের জয়েন্ট ভেঞ্চার। লুপ লাইনসহ এ অংশে সব মিলিয়ে ৬৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে। রেলপথটি তৈরির জন্য ১ লাখ ১১ হাজার ৭৫৩টি স্লিপার প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৫১ হাজার ৬১২টি স্লিপার প্রকল্প এলাকায় সরবরাহ করতে পেরেছে। এর প্রভাবে মূল রেলপথ বসানোর কাজটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

রেলপথের কাজে ব্যবহার হওয়া স্লিপারগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই উৎপাদন করছে। প্রয়োজন অনুযায়ী স্লিপার সরবরাহ করতে না পারার জন্য কাঁচামাল সংকটকে দায়ী করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে ‘দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার’ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক বিমল সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, পাথর, রডের মতো স্লিপার তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। এসব কাঁচামাল সংগ্রহের পরিকল্পনায় প্রথম ব্যাঘাত ঘটে করোনা মহামারীতে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও কাঁচামাল আমদানি করা কঠিন হয়ে গিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছি না। ফলে কাঁচামাল আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে স্লিপার উৎপাদনে।

রেলপথে যে পাথর বিছানো হয়, তার দুটি স্তর থাকে। নিচের স্তরের পাথরকে বলা হয় সাব ব্যালাস্ট, যেগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট। নির্মাণাধীন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের নকশা অনুযায়ী, তিনটি স্তরে সাব ব্যালাস্ট বিছানো হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি-তমার আওতাধীন দোহাজারী-চকরিয়া অংশে তিন স্তরে সব মিলিয়ে প্রায় ১৮৩ কিলোমিটার সাব ব্যালাস্ট কাজ করা হবে। ঠিকাদারের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সাব ব্যালাস্টের কাজ করা হয়েছে ৪০ কিলোমিটারের মতো। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রতি মাসে ২৮ কিলোমিটারের বেশি সাব ব্যালাস্ট বিছানোর প্রয়োজন হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসে মাত্র তিন কিলোমিটারের মতো সাব ব্যালাস্ট বিছাতে পারছে।

ছোট পাথরের স্তরের ওপর বিছানো হয় বড় আকারের পাথর, যা টপ ব্যালাস্ট নামে পরিচিত। নকশা অনুযায়ী, দোহাজারী-চকরিয়া অংশের জন্য সব মিলিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭০২ কিউবিক মিটার পাথর প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাথর সংগ্রহ করেছে ৬৭ হাজার ৩০০ কিউবিক মিটার। এখনো ৫৫ শতাংশ পাথর সংগ্রহ করা হয়নি।

রেললাইনের দুটি অংশ জোড়া দেয়া হয় এক ধরনের বিশেষ লোহার পাত দিয়ে, যেটি ওয়েল্ডেড রেল জয়েন্ট নামে পরিচিত। দোহাজারী-চকরিয়া অংশের জন্য ১২ হাজার ওয়েল্ডেড রেল জয়েন্ট প্রয়োজন হলেও এখনো তার একটিও সংগ্রহ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যদিও চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছরের মে মাসের মধ্যে রেলপথ জোড়া দেয়ার সব কাজ শেষ করার কথা তাদের।

নির্মাণ উপকরণ সংকটের কারণে কাজ বিঘ্নিত হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুতই সংকট কাটিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তমা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক বিমল সাহা বলেন, রেলপথটির কাজের জন্য যেসব পাথর প্রয়োজন, সেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। আমরা ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পাথর আমদানি করছি। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা পাথর পাচ্ছি না। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, খুব শিগগির পাথরের সংকট কেটে যাবে। সংকট কাটিয়ে লক্ষ্য অনুযায়ীই আমরা সব কাজ শেষ করতে সক্ষম হব।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের দ্বিতীয় অংশের (লট-২) কাজ সিআরইসির সঙ্গে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির কাজ করছে এ জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ উপকরণের সংকট রয়েছে রেলপথটির এ অংশের নির্মাণকাজেও।

চকরিয়া-কক্সবাজার অংশে ব্যবহূত বেশির ভাগ পাথর মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করছে সিআরইসি-ম্যাক্সের জয়েন্ট ভেঞ্চার। এ অংশে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬১ কিউবিক মিটার পাথর প্রয়োজন। এর মধ্যে এখনো প্রকল্প এলাকায় প্রায় ৬৩ হাজার বা ৩৭ শতাংশ পাথর সরবরাহ বাকি রয়েছে।

অন্যদিকে সাড়ে ১২ হাজার ওয়েল্ডেড রেল জয়েন্টের মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ১০০টি প্রকল্প এলাকায় সরবরাহ করা হয়েছে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী, আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে এসব কাজ শেষ করার কথা।

তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের চকরিয়া-কক্সবাজার অংশে নির্মাণ উপকরণের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রজেক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আহমেদ সুফি। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের অংশে নির্মাণ উপকরণের কোনো সংকট নেই। অগ্রগতিও বেশ ভালো। সেতু-কালভার্টগুলোর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এ মুহূর্তে পাথরের কোনো সমস্যা আমাদের নেই। টপ ব্যালাস্ট প্রয়োজনীয় পরিমাণে আছে। অবশিষ্ট যেসব পাথর রয়েছে, সেগুলো খুব শিগগির চলে আসবে। একইভাবে আমরা প্রতিদিন ৬০টি রেল জয়েন্টের কাজ করছি। আগামী নভেম্বরের মধ্যে আমাদের ৫০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে অন্তত ৪০ কিলোমিটার পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশন এলাকায় অনেকগুলো লুপ লাইন তৈরি করতে হবে। সেখানে কিছুটা সময় লাগবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি। এক বছরের ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এ হিসাবে আগামী বছরের জুনে প্রকল্পের সব কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। এমন প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অবশ্য প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পটির পরিচালক মফিজুর রহমান বলছেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মূল কাজগুলো শেষ হয়ে যাবে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রেলপথটির নির্মাণকাজ লক্ষ্য অনুযায়ী এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার অংশের নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। তবে জুনের দিকে বর্ষাকাল হওয়ায় কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এজন্য আমাদের পরিকল্পনা হলো মূল কাজগুলো জুনের মধ্যে শেষ করা। যেন ইচ্ছা করলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় ট্রেন চলাচল শুরু করতে পারে। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা রেলপথটির সব কাজ শেষ করব। সুত্র: বণিক বার্তা

পাঠকের মতামত

চকরিয়ায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের হট্টগোল

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষের মধ্যে হট্টগোল হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল ...