ডেস্ক রিপোর্ট::
সর্বনাশা ইয়াবা শুধু মিয়ানমার থেকেই আসছে এমন নয়, এখন দেশেও তৈরি হচ্ছে গোপনে। কিছু ওষুধ থেকে কৌশলে একটি বিশেষ রাসায়নিক উপাদান বের করে নিজেরা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বানিয়ে ফেলছে ইয়াবা।
সারা দেশে এরই মধ্যে পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান। আরো কারখানা রয়েছে বলে ধারণা করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেগুলোর খোঁজ করছে। ধরা পড়া ইয়াবা কারিগররা অবৈধ এ কারবারে জড়িয়ে পড়ার কারণ জানাতে গিয়ে পুলিশকে বলেছে, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল জোগাড় করে দেশে ইয়াবা তৈরিতেই বেশি লাভ। মাত্র দুই হাজার টাকার কাঁচামালে দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা আয় করা যায়। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ইয়াবা কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে এবং ওই সব কারখানা থেকে আটক ব্যক্তিরা ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে পুলিশকে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে আটককৃতরা বলেছে, রাসেল মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি সহযোগী নজরুলকে নিয়ে বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে ইয়াবা তৈরিতে সহযোগিতা করেন। মোটা টাকার বিনিময়ে ইয়াবা তৈরির যন্ত্রও জোগাড় করে দিতেন এই দুজন। জানা যায়, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল বিভাগের ছাত্র রাসেল পাস করার পর ইয়াবা তৈরিতে নামেন। গত বছরের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাসেল পুলিশকে জানান, প্রথমে ইয়াবার বাহক ছিলেন তিনি।
পরে পরিচিত আরেকজনের কাছ থেকে ইয়াবা তৈরি করা শিখে নিজেই বিশেষজ্ঞ হয়ে যান।
রাসেল পুলিশকে জানিয়েছেন, ইয়াবা তৈরিতে সুডোফেড্রিন নামের রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োজন হয়। গত বছর বেশ কয়েকটি কারখানা আবিষ্কারের পর সরকার এই রাসায়নিক দ্রব্যটির আমদানি নিষিদ্ধ করে। তবে বিশেষ পদ্ধতিতে এই রাসায়নিক সংগ্রহ করে ইয়াবা তৈরি অব্যাহত রেখেছে কারবারিরা। জানা গেছে, ২০ থেকে ২৫ ধরনের ওষুধে সুডোফেড্রিন রয়েছে। সেসব ওষুধ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে সুডোফেড্রিন বের করে তার সঙ্গে ফসফরাস যোগ করে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মিথাইল এমফিটামিন বানানো হয়। এই এমফিটামিনের সঙ্গে রং ও অন্যান্য রাসায়নিক মিলিয়ে ইয়াবা তৈরি করা হয়। মিয়ানমারসহ অনেক দেশে ইয়াবাকে বলা হয় মেথাফিটামিন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে একসময় ইয়াবার মূল উপাদান আমদানি করা হতো। রাসায়নিক দ্রব্যটি দিয়ে ইয়াবা তৈরি হচ্ছে জানার পর উপাদানটির আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়।
ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে তৈরি হয়ে দেশে ঢুকছে উল্লেখ করে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দেশেও কিছু কারখানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। দেশে এখনো যেসব ইয়াবা কারখানা আছে তার সন্ধান চলছে। চলমান অভিযানে ইয়াবা নির্মূল করতে প্রয়োজনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইয়াবাবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা এলাকার হরিপুর গ্রামের একটি টিনশেড বাড়ি ঘেরাও করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। কক্ষে প্রবেশ করেই দেখা যায় একাধিক ইয়াবা তৈরির যন্ত্র সাজানো। সেখান থেকে তৈরি ইয়াবা, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। ওই বাড়ির মালিক হাবিবুরের স্ত্রী লাকীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে লাকী স্বীকারোক্তিতে জানায়, দীর্ঘদিন ধরে তারা এই বাড়িতে গোপনে ইয়াবা তৈরি করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ইয়াবা কারবারিদের কাছে সরবরাহ করে আসছিল। বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকত। ভেতরে মনিটরেই দেখা যেত বাড়িতে কারা যাতায়াত করছে। এই বাড়িতে যখন অভিযান চালানো হয় তখন তার স্বামী হাবিবুর রহমান কেটে পড়েছে।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ব্যাপারীপাড়া কমিশনার গলির এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আড়াই লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এই বাড়িতে আড়াই লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরি করত আবুল হোসেন সওদাগর নামের এক ব্যক্তি। বাড়িটি থেকে চারটি স্টিলের ডাইস, দুটি প্রেশার মেশিন, ডিজিটাল স্কেল, জার ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। আবুল হোসেন পুলিশকে বলেছে, তার কারখানায় উত্পাদিত ইয়াবার এজেন্ট ছিল আবদুল্লাহ আল নোমান ওরফে আবদুল্লাহ আল আমান নামের এক ব্যক্তি। নোমান এসব ইয়াবা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের দায়িত্বে ছিল। আমানকে পরে গ্রেপ্তার করা হয়। মামুন হোসেন ও আয়মা সিদ্দিকী নামে দুই ব্যক্তি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে তাদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়।
এ ছাড়া ময়মনসিংহের চুরখাই এলাকার কোরাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে র্যাব আরেকটি ইয়াবার কারখানা আবিষ্কার করে। সেখান থেকে ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির সরঞ্জাব উদ্ধার করা হয়। কারখানার মালিক বদিউর রহমান ও তার সহযোগী সজীবকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুইল এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় যন্ত্রপাতিসহ আমজাদ হোসেন, সামিউল ইসলাম ও রাজেস চৌধুরী শ্যামকে। নারায়ণগঞ্জ মডেল থানায় দায়ের করা মামলা থেকে জানা যায়, এই কারখানার ইয়াবার বড় বড় চালান দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত। কারখানাটিতে ঘণ্টায় ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উত্পাদন করা যেত।
২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়া টেংরা এলাকার মা মেমোরিয়াল স্কুল গলির একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা তৈরির সরঞ্জামসহ নাসির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। এই মিনি কারখানায় প্রতিদিন ৫০০ পিস ইয়াবা তৈরি করে খুচরাভাবে বিক্রি করত বলে নাসির পুলিশের কাছে স্বীকার করে।
২০১৪ সালের ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী বাঁশপট্টির ১২০ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ ইয়াবার কারখানার সন্ধান পায়। কারখানায় উত্পাদিত এক হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা ও এর কাঁচামাল জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আলী আকবর, সোহেল ও রুবেল নামে তিনজনকে। ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের একটি বাসা থেকে ইয়াবা কারবারি জসিম উদ্দিন ওরফে শিমুল, সৈয়দ তরিকুল ইসলাম ওরফে সুমন, মো. আলী আকবর, জুবায়ের হোসেন জুয়েল ও কীর্তি আজাদ ওরফে টুটুলকে ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটককৃতরা স্বীকার করে, তারা এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উত্পাদন চলত, যার ক্রেতা ছিল রাজধানীর বিভিন্ন ইয়াবা কারবারি।
২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালের সামনে থেকে একটি পাজেরো জিপ আটক করে ডিবি পুলিশ বিপুল পরিমাণ ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি উদ্ধার এবং ৫৫ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে। আবদুল্লাহ জুবায়ের নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে চারজন মাদক কারবারি এসব যন্ত্রপাতি টেকনাফ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসছিল। আবদুল্লাহ জুবায়ের পুলিশের কাছে স্বীকার করে, ঝুঁকি এড়াতে বিলাসবহুল গাড়িতে করে এই যন্ত্রপাতি ও ইয়াবার চালান ঢাকা আনা হচ্ছিল। যারা আটক হয়েছিল তারা হচ্ছে আইয়ুব আলী, শামসুল আলম ও মোস্তাকিন হোসেন। গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, গুলশান নিকেতন এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ২০৫/৩ নম্বর বাসার সাত ও আট তলায় এই কারখানা গড়ার পরিকল্পনা ছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর গুলশানের দুটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আমিন হুদা ও তার সহযোগী আহসানুল হক হাসানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই দিন তাদের হেফাজত থেকে ৪২ ধরনের ১৩৮ বোতল বিদেশি মদ, এক লাখ ৩০ হাজার আইস পিল (ইয়াবার বিকল্প), ভায়াগ্রা ট্যাবলেট, এসব তৈরির সরঞ্জাম, ফেনসিডিল, বিভিন্ন দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও ১২টি মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার করা হয়। সরাসরি ইয়াবা তৈরি করা না হলেও ইয়াবার বিকল্প আইস পিল তৈরি হতো ওই যন্ত্রপাতি দিয়ে। এই মামলার রায়ে ২০১২ সালে আমিন হুদা ও তার সহযোগীর ১৪ বছর করে কারাদণ্ড হয়। এর পর ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে প্রথম ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। নগরীর কক্সবাজার এলাকায় প্যারেড ময়দানসংলগ্ন বাসা থেকে কারখানার মালিক রাখাল চন্দ্র ধর নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। সেখান থেকে ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল, তিন প্যাকেট রং, ২০ বোতল ইয়াবার রাসায়নিক দ্রব্য, ইয়াবা তৈরির ডায়াস ও তৈরি করা দুই হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। কারখানা মালিক রাখাল চন্দ্র পুলিশের কাছে স্বীকার করে, তাদের উত্পাদিত ইয়াবার ক্রেতা মাদক কারবারিরা। এর আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়ও মিনি কারখানার সন্ধান পায় চট্টগ্রাম পুলিশ। পুলিশ প্রশাসন এর পর থেকে নিশ্চিত হয়—বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন অভিযানে বেশ কিছু ইয়াবা তৈরির কারখানা আবিষ্কার হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি মাদকবিরোধী এক ব্রিফিংয়ে বলেন, যতক্ষণ না মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।