হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ ::
অচলাবস্থার পর গতি ফিরে পেয়েছে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য। অক্টোবর এক মাসেই টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৯ কোটি ৫৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা। যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ৪১ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা বেশী। অক্টোবর মাসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৪ লক্ষ টাকা। ২৬ নভেম্বর বিকালে টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সুত্র উক্ত তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা যায়, অক্টোবর মাসে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে ৪৮ কোটি ৫৮ লক্ষ ৪৯ হাজার ৮৭৫ টাকা মুল্যের পণ্য মিয়ানমার থেকে আমদানী হয়েছে। এতে ৪৮ কোটি ৪৫ লক্ষ ৮১ হাজার ২৪০ টাকা মুল্যের পণ্য শুল্কযুক্ত এবং ১২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৬৩৫ টাকা মুল্যের পণ্য শুল্কমুক্ত। ৩১১টি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে পণ্য আমদানী খাতে টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৯ কোটি ৫৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৯৪ টাকা। ভয়াবহ রোহিঙ্গা সমস্যা থাকা সত্বেও অক্টোবর মাসে শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে ৮ হাজার ৭৮৭টি গরু, ১ হাজার ৮৮টি মহিষ এবং ৩১৪টি ছাগল আমদানী হয়েছে। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল প্রতিটি ২০০ টাকা হারে এ খাতে টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস রাজস্ব আয় করেছে ৫০ লক্ষ ৩০০ টাকা। তাছাড়া অক্টোবর মাসে ২৭টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ৩৯৪ টাকা মুল্যের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মিয়ানমারে রপ্তানী হয়েছে। তম্মধ্যে ১১টি চালানে ৮৪ লক্ষ ৮ হাজার ৬৫৮ টাকা মুল্যের ১৩২.৬৪৪ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, ১টি চালানে ১ লক্ষ ৪ হাজার ৪৫৮ টাকা মুল্যের ১.২৭৮ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ২টি চালানে ১ লক্ষ ৪ হাজার ৬২২ টাকা মুল্যের ১.১৬ মেট্রিক টন শুটকি মাছ, ৪টি চালানে ৯ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৩৪ টাকা মুল্যের ৫.৮ মেট্রিক টন পাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৬ হাজার ১৩০ টাকা মুল্যের ০.১৫ মেট্রিক টন চিপস, ৫টি চালানে ৩ লক্ষ ৭৮৭ টাকা মুল্যের ০.৯২ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ২ লক্ষ ৬৪ হাজার ৬৭৭ টাকা মুল্যের ১.১৩ মেট্রিক টন গাজী প্লাস্টিক ট্যাংক, ১টি চালানে ১ লক্ষ ৩ হাজার ৮০৪ টাকা মুল্যের ১.০০০ মেট্রিক টন এ্যালুমুনিয়াম প্রোডাক্টস, ১টি চালানে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ১২৪ টাকা মুল্যের ০.৬ মেট্রিক টন বাংলাদেশী লুঙ্গি।
তুলনামুলক সেপ্টেম্বর মাসের খতিয়ান হচ্ছে ১৪১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানী হয়েছিল মাত্র ২৮ কোটি ৪৭ লক্ষ ২২ হাজার ৬৬২ টাকা মুল্যের পণ্য। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ১৬১ টাকা। এ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ৮৩৯ টাকা কম আয় হয়েছে। রপ্তাণী বাণিজ্যের চিত্র ছিল আরও শোচনীয়। আগে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা মুল্যের শতাধিক চালানে বিভিন্ন প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মংডু টাউনশীপে রপ্তানী হত। কিন্ত সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৬টি চালানে ৩৭ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকা মুল্যের ৭ প্রকারের বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তাণী হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৪টি চালানে ২৫ লক্ষ ৬০ হাজার ৮৩ টাকা মুল্যের ৪৪.৪৮ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, ৩টি চালানে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯৬০ টাকা মুল্যের ১.৯২ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ৩টি চালানে ৯ হাজার ৮১০ টাকা মুল্যের ০.০৮ মেট্রিক টন শুটকি মাছ, ২টি চালানে ৭ লক্ষ ৩ হাজার ৫০ টাকা মুল্যের ৫.৯ মেট্রিক টন ফাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৩০ হাজার ৬৫৬ টাকা মুল্যের ০.৭৫ মেট্রিক টন চিপস, ২টি চালানে ২ লক্ষ ৬৯ হাজার ৭৭৫ টাকা মুল্যের ০.৮২৫ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ৬১ হাজার ৫৫৮ টাকা মুল্যের ১.৫ মেট্রিক টন জুট ব্যাগ। তবে কুরবানীর ঈদের মাসে হওয়ায় গবাদিপশু আমদানী খাতে আয় ভাল ছিল। ঈদের আগে থেকেই দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল। সেই সাথে বৈধ ও অবৈধ পথে গবাদিপশু এসেছে প্রচুর। ২ সেপ্টেম্বর শনিবার বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানীর জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীরদ্বীপ ২টি ক্যাডল করিডোর রয়েছে। তম্মধ্যে হ্নীলা করিডোর দিয়ে কোন গবাদিপশু আমদানী হয়নি। শাহপরীরদ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মোট গবাদিপশু আমদানী হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২টি। এরমধ্যে ৬ হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ, ২ হাজার ৫৬৬টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লক্ষ ১ হাজার ২০০ টাকা।
উল্লেখ্য, ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের মংডু শহর থেকে টেকনাফ স্থল বন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যের কোন পণ্য আসেনি। অঘোষিতভাবে বন্দ হয়ে গিয়েছিল টেকনাফ-আকিয়াব সীমান্ত বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদেরকে মংডু টাউনশীপের কতৃপক্ষ টেকনাফ বন্দরে মালামাল আনতে দেয়নি। সেই সাথে আমদানী-রপ্তাণীকারকদের যাতায়ত এখনও বন্দ রয়েছে। তবে স্বল্প পরিসরে আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে যৎসামান্য পণ্য আমদানী হয়েছিল। রপ্তানী বাণিজ্যের চিত্র ছিল আরও শোচনীয়। মিয়ানমারের মংডু কতৃপক্ষ একতরফা ও অঘোষিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্দ রাখায় রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছিল। টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আগে যেখানে প্রতিমাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পরও কয়েক কোটি টাকা বেশী আয় হত, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। এমনকি টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশীপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থল বন্দরে আটকা পড়েছিল।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের এই পয়েন্টটি ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’ নামে পরিচিত এবং পরিচালিত। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ এবং মংডু টাউনশীপে পৃথকভাবে আড়ম্বরপুর্ণ অনুষ্টানের মাধ্যমে আনুষ্টানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসার করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখে আসছে ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্ত মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংস ঘটনায় আরাকানের কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, আইন শৃংখলা বাহিনী সর্বোপরি বাংলাদেশ সেনা বাহিনী সর্বোচ্চ সংযম, ধর্য, কৌশল, দক্ষতা প্রদর্শন পূর্বক পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। যা সারা দুনিয়া জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্ত মিয়ানমারে সহিংস ঘটনায় বাংলাদেশের পক্ষে কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ করা না হলেও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় আরাকান রাজ্যের (পরিবর্তিত নাম রাখাইন স্টেট) অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ও জেলা শহর মংডু অঘোষিত ও একতরফাভাবে টেকনাফ স্থল বন্দরের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য বন্দ করে দিয়েছিল। এতে টেকনাফ স্থল বন্দর ব্যবহারকারী আমদানী-রপ্তাণীকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শত শত শ্রমিক আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রতি দিন মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হন।
২৬ নভেম্বর বিকালে সরেজমিন টেকনাফ স্থল বন্দর পরিদর্শনকালে দেখা যায় আগের সেই কর্ম ও প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। আমদানী ও রপ্তানীকারক এবং বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীগণ জানান, ১৪ অক্টোবর থেকে আগের মতোই পুরো দমে পণ্য আমদানী-রপ্তানী শুরু হয়েছে। টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশীপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা মিয়ানমারে সহিংসতার কারণে টেকনাফ স্থল বন্দরে আটকা পড়েছিল, তাঁরাও স্বদেশে ফিরে গিয়েছেন। এখন আগের নিয়মে মালামাল নিয়ে আসছেন। ২০ দিন অচলাবস্থার পর গতি ফিরে পাওয়ায় অক্টোবর মাসেই মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। ##