প্রকাশিত: ২৩/১১/২০২১ ৯:৪৫ এএম

মিয়ানমারের বুছিডং এলাকায় দেশটির সামরিক বাহিনীর নজিরবিহীন হত্যা-নিপীড়নের জ্বলন্ত সাক্ষী আবদুল বাছেদ। সে সময় অনেকের সঙ্গে হত্যার শিকার হন তার চাচা জহির উদ্দিন। তার অনেক আত্মীয়-স্বজনকে সেসময় অকাতরে জীবন দিতে হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রী, চার সন্তানসহ বাংলাদেশে পাড়ি জমান বাছেদ। উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ ব্লকে আশ্রয় নেন তিনি।
চার বছর আগের মিয়ানমারের সেই দুঃসময়ের স্মৃতি এখনও অন্যান্য রোহিঙ্গার মতো বয়ে বেড়ান তিনি। সেই সময়টা এখনও তাড়া করে ফিরে তাকে। বাংলাদেশে এসে ভালোই কাটছিল তার সময়। কিন্তু কিছু দিন পার হওয়ার পর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দাপটে ক্যাম্প জীবনও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পার হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র গ্রুপগুলো। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক কারবার ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। রোহিঙ্গা হয়েও সাধারণ রোহিঙ্গাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তারা। এমন বাস্তবতায় ক্যাম্পে আরও ভীতির পরিবেশ তৈরি করে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা ও ‘সিক্স মার্ডার’-এর ঘটনা।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ রোহিঙ্গারা এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে নানা তৎপরতাও চালান। তাতে তেমন ফল মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে রাতের ক্যাম্পে ‘ভয়কে জয় করার’ এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। জামতলী ক্যাম্পে এ উদ্যোগের অন্যতম নেতৃত্বে রয়েছেন সাহসী যুবক বাছেদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তারা ৫ জনের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পাহারা দিচ্ছেন ক্যাম্পের নিজ নিজ আঙিনা।
সম্প্রতি সরেজমিনে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেল নানা তথ্য। উখিয়ার জামতলীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ ব্লকের মাঝি বাছেদ প্রায় প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারেন। গত ১৭ নভেম্বর তিনি সমকালকে বলেন, কিছু লোকের কারণেই ক্যাম্পের পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কথা না শুনলে ওরা একে-ওকে মারধর করে। মাসখানেক আগেই এইচ ব্লকে এক তরুণীর ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ। এতে রাজি না হওয়ায় তার এ পরিণতি।
বাছেদ আরও বলেন, অনেকে আরসার নাম ভাঙিয়ে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করে। ছলিম নামে একজন নিজেকে জামতলীর চারটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কমান্ডার বলে দাবি করত। তারা আশপাশের এলাকা প্রায় জিম্মি করে রেখেছিল। সন্ধ্যা নামলেই তাদের উৎপাত বাড়ত। তবে এখন সাধারণ রোহিঙ্গারা এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে রুখে দিতে চাচ্ছে। মাসখানেক ধরে রাতে ক্যাম্পে পালাক্রমে সাধারণ রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ এলাকায় যারা নিরাপত্তা দিচ্ছেন তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে লাঠি। রাতে কেউ আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করলে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরই মধ্যে জামতলী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মৌলভী মনির, ছলিম, ইয়াহিয়া, ইমাম হোসেন, মৌলভী নাসিরকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর থেকে ক্যাম্পে অনেকটাই স্বস্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে। তবে জামিন পেয়ে আবার ওই গ্রুপটি ক্যাম্পে ফেরত আসতে পারলে কী পরিবেশ সৃষ্টি হবে এ নিয়ে অজানা শঙ্কাও আছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার ৪০ মিনিটে কুতুপালং ক্যাম্পে নিজ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে। এরপর ২২ অক্টোবর রাতে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসায় সিক্স মার্ডারের ঘটনা ঘটে। এরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্প টহল জোরদার করে। এর পাশাপাশি রাতে শুরু করে ব্লক অভিযান।
তবে উখিয়ায় একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনাকীর্ণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ রোহিঙ্গারা যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আগেই সেই তথ্য প্রশাসনকে জানিয়ে দেন এতে সেখানে বড় ধরনের কোনো অঘটনের আশঙ্কা থাকবে না।
অন্তত ৩ জন রোহিঙ্গা ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়ায় সিক্স মার্ডারের পর ২৩ অক্টোবর প্রথমে শফিউল্লাহ কাটা ও জামতলী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকা রাতের পাহারার আয়োজন করে এপিবিএন-৮। এরপর চলতি মাসের ১০ নভেম্বর থেকে উখিয়ার সব ক্যাম্পে এই পদ্ধতি চালু করে নিরাপত্তা ছক সাজানো হয়। উখিয়ায় মোট ১১টি ক্যাম্পের ব্লক ১৭টি আর সাবব্লক ৭৭৩টি। এসব ক্যাম্পে ৩ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ জন রোহিঙ্গার বসবাস। শুধু জামতলী ক্যাম্পে আছে ৫৩ হাজার ৪৬০ জন। প্রতিদিন ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গড়ে পাহারাদার ৩ হাজার ৮০০ জন। রোটেশন অনুযায়ী পাহারার দায়িত্ব পড়ে। মোট পাহারা পোস্ট ১০১টি। প্রত্যেক পাহারাদার টিমের দলনেতার মোবাইল নম্বর পুলিশের কাছে রয়েছে। আবার তাদের কাছেও পুলিশের নম্বর রয়েছে। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার আভাস পেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করেন তারা।
উখিয়ার জামতলীর বি ব্লকের মাঝি নুরুল ইসলাম বলেন, রাত ৮টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সবাই মিলে পাহারা দিচ্ছি। ভয়ে কোনো খারাপ লোক এলাকার ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। হাতে লাঠিসোটা থাকলেও এখন দরকার সবার বাঁশি ও পৃথক ড্রেস। যাতে কেউ দেখলেই বুঝতে পারে আমরা পাহারাদার।
ইছমাইল নামে আরেক রোহিঙ্গা জানান, একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা মেয়েদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করছে। নিজের ইচ্ছা মাফিক বিয়ে করতে না পারায় জামতলী ক্যাম্পে কয়েক মাস আগে এক মেয়ে আত্মহত্যা করে।
ইছমাইল এও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্মান নিয়ে এখন দ্রুত নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চাই। সেখানে আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি পড়ে আছে। ওর মায়া কীভাবে আমরা ভুলব।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি হায়দার আলী খান সমকালকে বলেন, ক্যাম্পের কে ভালো কে দুষ্ট এটা রোহিঙ্গারা ভালো বুঝতে পারবেন সবার আগে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিরাপত্তায় যারা নিয়োজিত পুলিশের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর তাদের কাছে দেওয়া আছে। কেউ এলাকায় অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তারা পুলিশকে খবর দিচ্ছেন।
কক্সবাজার এপিবিএন-৮-এর অধিনায়ক মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান সমকালকে বলেন, উখিয়ায় ক্যাম্পের প্রতি সাব ব্লকে ৪৬৮ জন রোহিঙ্গা বাস করে। গড়ে ২০ দিন পরপরই একেকটি টিমের রাতের পালায় নিরাপত্তা ডিউটি পড়ে। কোনো ঘটনা ঘটলেই প্যাট্রোল ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের তারা খবর দেয়। পুলিশ দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়। এতে পরস্পরের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তায় এই মডেল বেশ আশাব্যঞ্জক। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলছে।
এপিবিএন-৮-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম সমকালকে বলেন, শফিউল্লাহ কাটা ও জামতলী ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রথমে নিজ নিজ এলাকার নিরাপত্তার রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা চালিয়ে যেতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আমরা উদ্বুদ্ধ করেছি। সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত

উখিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই – জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর বিবৃতি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রেক্ষাপটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বিবৃতি দিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ...