বাংলা ট্রিবিউন ::
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়, তখন তৎকালীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই আন্দোলন দমন করতে নানা পথ খুঁজছিল। সে সময় আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে রাজধানীর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে সাত দিন ধরে তাদের ওপর চলে নানা চাপ, হুমকি ও অপমানজনক আচরণ। অস্ত্রের মুখেও তাদের আদর্শচ্যুত করা সম্ভব হয়নি—বরং এই ঘটনাই আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে।
পৃথক সময় ও স্থান থেকে বলপ্রয়োগ করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ জুলাই ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নেওয়া হয়। পরদিন ২৭ জুলাই সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয় সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে। ২৮ জুলাই ভোরে বাসায় হানা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নুসরাত তাবাসসুমকে।
এই সাত দিন ডিবি হেফাজতে কী ঘটেছিল, তার কিছুটা জানাজানি হলেও অনেক কিছুই এখনও অজানা। তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া সংবাদ সম্মেলন আয়োজন, পরিবারের সদস্যদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা, ভিডিও বার্তা রেকর্ড করানো, অনশন কর্মসূচি গোপন রাখা—এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে আসে।
ডিবি হেফাজতে নেওয়ার কোনও আইনগত ভিত্তি নেই—এ বিষয়ে সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অথচ সমন্বয়কদের আটকের ক্ষেত্রে এসব বিধান মানা হয়নি।
পরে ছয় সমন্বয়কের দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ১৯ জুলাই থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিন্ন করতে গুম, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি শুরু হয়। ডিবি হেফাজতের সাত দিনেও চলে সেই ধারাবাহিকতা। সরকার ও ডিবি কর্তৃপক্ষ যদিও ‘নিরাপত্তার জন্য’ আটকের কথা বলেছিল, বাস্তবে তাদের বিচ্ছিন্ন রেখে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা ছিল।
তাদের ভাষ্য, আমরা মতপ্রকাশের অধিকার চেয়েছিলাম, নিরাপত্তার নামে আটকের নাটক চাইনি। ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ভিডিও স্টেটমেন্ট আমাদের স্বেচ্ছায় দেওয়া ছিল না। আমাদের কোনো সিদ্ধান্তই আন্দোলনের সব অংশগ্রহণকারীকে ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়।
যৌথ বিবৃতিতে তারা আরও জানান, ডিবি অফিসে তাদের জোর করে খাবারের টেবিলে বসিয়ে ভিডিও রেকর্ড করা হয়। পরিবারের সদস্যদের ডেকে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে, অথচ দেখা করতে দেওয়া হয়নি। অনশন কর্মসূচি চালু করা হলেও তা বাইরে জানানো হয়নি।
৩০ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অনশন ছিল তাদের প্রতিরোধের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার প্রথম অনশনে বসেন। পরে সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত তাবাসসুম অনশনে যোগ দেন। প্রায় ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ডিবি প্রধান মুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে অনশন ভাঙা হয়। ১ আগস্ট দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে পরিবারের জিম্মায় তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
এই পুরো সময়টিতে তাদের ও পরিবারের সদস্যদের ওপর হয়রানি, ভয়ভীতি, চাপ প্রয়োগ, এমনকি নাটকীয় মঞ্চায়নের অভিযোগও উঠে। সমন্বয়করা অভিযোগ করেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তাদের অন্যায়ভাবে আটক রাখা হয়েছিল। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল।
ছাড়া পাওয়ার পর সমন্বয়করা সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবারও আন্দোলনের ঘোষণা দেন এবং রাজপথে নামার জন্য সারাদেশের ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
অভিজ্ঞতা বর্ণনা
সেই কঠিন সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু বাকের মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ওই সময়ের অসংখ্য স্মৃতি আছে যেগুলো বেদনাদায়ক। তার মধ্যে নাহিদ ভাই ও আসিফ ভাই খুব বেশি অসুস্থ ছিলেন। আমরা তিন জন একই ফ্লোরে ছিলাম মাঝেমধ্যে দেখা হতো গেস্ট রুমে। যেখানে চাপ প্রয়োগ করতো, এটা আমার কাছে খারাপ লাগার ছিল। এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে। খাবার খেতে দিতো বরং আমরা খেতে চাইতাম না। পরে তো আমরা অনশনে চলে যায়। এখানে একেকজন একেক রকম চাপ দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাপ দিয়েছিল নাহিদ ভাইকে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মারধর করেছে, খারাপ ব্যবহার করেছে, প্রথম দিন পিস্তল সামনে রেখে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। আরেকটা বিষয় জুলাই আন্দোলনে ডিবির সদস্যরা কে কয়টা গুলি চালাতো, তা কার্যালয়ে এসে রিপোর্ট দেওয়া লাগত। রিপোর্ট দেওয়া সময় একজনকে দেখেছি, একদিনে সে গুলি চালিয়েছে প্রায় ৪৩টি। আবার কেউ কেই দেখেছি দুইটা-তিনটা করে গুলি চালিয়েছে এমন রিপোর্ট দিচ্ছে। বেশিরভাগই খুব কম রাউন্ড গুলি চালিয়েছে এর মধ্যে এক দুজনকে দেখলাম যে বেশি গুলি চালিয়েছে। যারা অতিরিক্ত গুলি চালিয়েছে, এই লোকগুলোকে মূলত আওমী লীগের লোক মনে হয়েছে। এ সন্দেহটা আমাদের হয়েছে।’
‘এছাড়া এসময় বাইরে আরও যারা ছিল, আমাদের সহযোদ্ধা তাদের জন্য আমাদের খারাপ লাগছিল। আমরা যখন ডিবি অফিসে ছিলাম এসময় বাইরে আন্দোলনটা তেমন স্ট্রংলি হচ্ছিল না। তবে পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ আমাদের পক্ষেও ছিল। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য পেতাম।’
আবু বাকের মুজমদার আরও বলেন, ‘সাহসী ভূমিকা ছিলই আমরা যে ডিবি হেফাজতে আছি এইরকম মানসিকতা ছিল না। আমরা যে এদের হেফাজতে আছি, তাদের ভয় পাচ্ছি; সেটা বুঝতে দেইনি। আমরা প্রতিদিনই সাহসী ভূমিকা রেখেছি। তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যেতাম। আমাদের সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা ছিল অনশনে বসা। এসময় আমাদের শেখ হাসিনার দেখা করানোর জন্য একটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। তখন আমরা বলেছি, আমরা শেখ হাসিনার দেখা করবো না; এজন্যই অনশনে বসেছি। আমাদের নিতে পারেনি, এটা আমাদের সঠিক একটা সিদ্ধান্ত ছিল। ডিবি হেফাজতে অনেক ভয়ংকর ছিল, ক্রিটিকালও ছিল। আমরা অনেক মেকানিজম করেছি, ওরাও করেছে। এটা গেইম ছিল। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসা হয়েছে তাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। মানে এটা একটা মাল্টিডাইমেনশলা গেইম ছিল।’
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতা ও ওই সময় ডিবি হেফাজতে থাকা হাসনাত আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ডিবিতে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য—আন্দোলন বন্ধ করা। এজন্য আমাদের শারীরিক-মানসিক সবরকম নির্যাতন করা হয়েছে। সেখানে প্রত্যেককে একেকটা এডিসির আন্ডারে দেওয়া হয়েছিল। আমি ছিলাম এডিসি জুনায়েদের আন্ডারে। এই এডিসি জুনায়েদ পুরাটা সময় আমাকে বাথরুমের সামনে রাখে এবং সারাক্ষণ নানা হুমকি, ভয় দেখাতে থাকে। এই প্রসেসটা সব সময়ই চলতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়েও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বাইরে যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। তবে পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ আমাদের পক্ষেও ছিলেন, তাদের কাছ থেকেই কিছু তথ্য পাওয়া যেতো।