প্রকাশিত: ০৮/০৩/২০২১ ৯:৫৮ এএম

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সাগরলতাই গড়ে দেবে ইউরেনিয়ামসহ বিরল খনিজ পদার্থের ভান্ডার! স্থানীয়ভাবে ডাউঙ্গালতা বা পিঁয়া লতা নামে পরিচিত এই দ্রাক্ষালতাটি সমুদ্র সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরি করে বলে একে ‘বালিয়াড়ি তৈরির কারিগর’ও বলা হয়। আর সৈকতের বালিয়াড়িতে থাকে ইউরেনিয়ামসহ বিরল খনিজ পদার্থের মনিক। বিজ্ঞানী-গবেষকদের মতে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সাগরলতা চাষের মাধ্যমে আমরা মূল্যবান খনিজ সম্পদের অফুরন্ত মজুদ গড়ে তুলতে পারি এবং ব্লু-ইকনোমিতেও একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারি।
ইউরেনিয়াম একটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ভারী ধাতু, যা ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘনীভূত শক্তির প্রাচুর্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পারমানবিক চুল্লীর মূল জ্বালানী ইউরেনিয়াম। এক কেজি ইউরেনিয়াম থেকে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এক কেজি জ্বালানী তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় ১২ ইউনিট, আর এককেজি কয়লা থেকে মাত্র ৮ ইউনিট। অর্থাৎ তেল বা কয়লার শক্তির তুলনায় ইউরেনিয়ামের শক্তি ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ গুণ বেশি।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূ-তত্ত্ববিদ ও ত্রিশালস্থ জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন- সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতের ভূ-গর্ভস্থ মাটি ও পানি পরীক্ষা করে সেখানে পরমাণু চুল্লীর জ্বালানী বা ইউরেনিয়ামের উচ্চমাত্রায় অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সৈকতের খনিজ বালিতে থাকা মোনাজাইটে প্রায় ১৬% পর্যন্ত রয়েছে ইউরেনিয়াম। কক্সবাজারের মতোই একই ভূ-বৈশিষ্ট মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও কুয়াকাটায়। এটি ইঙ্গিত করছে, আমাদের সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িগুলোতে রয়েছে সেই মূল্যবান খনিজ। সুতরাং সাগরলতা যদি বালিয়াড়ি তৈরি করতে পারে, তাহলে বলা যায় সে ইউরেনিয়ামসহ বিরল খনিজ পদার্থের ভান্ডার গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সৈকতে পাওয়া মোনাজাইটে ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ছাড়াও বিরল খনিজ পদার্থ (আরএইএম) রয়েছে বলে জানান তিনি।

পৃথিবীর ১৭টি বিরল খনিজ পদার্থকে একযোগে ‘রেয়ার আর্থ মেটেরিয়াল/এলিমেন্ট’ বা আরইএম/আরইই বলা হয়। পদার্থগুলো হল- সেরিয়াম (সাংকেতিক নাম সিই), ডিসপ্রোজিয়াম (ডিওয়াই), এরবিয়ামি (ইআর), ইউরোপিয়াম (ইইউ), গ্যাডুলিনিয়াম (জিডি), হলমিয়াম (এইচও), ল্যান্থানাম (এলএ), লুটেটিয়াম (এলইউ), নিউডাইমিয়াম (এনডি), প্র্যাস্যুডিয়াম (পিআর), প্রোমেথিয়াম (পিএম), সামারিয়াম (এসএম), স্ক্যান্ডিয়াম (এসসি), টারবিয়াম (টিবি), থুলিয়াম (টিএম), ইত্তেরবিয়াম (ওয়াইবি) ও ইত্তিরিয়াম (ওয়াই)। আর উপাদানের সবগুলোরই অস্তিত্ব দেশে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক এ ভূ-তত্ত্ববিদ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান, প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, ইতোমধ্যে সৈকতের খনিজ বালিতে পাওয়া মোনাজাইটে যে ল্যান্থানাইড (এলএন) সিরিজ এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সে সিরিজেই ল্যান্থানাম (এলএ)সহ বিরল খনিজ পদার্থগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশেও যে আরইএম রয়েছে, তা এক প্রকার নিশ্চিত।
তিনি জানান, সাধারণত: মোনাজাইটে ৫০% ল্যান্থানাইড থাকে। তবে আমাদের দেশে এসব বিরল পদার্থের মজুদ বা মান নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হয়নি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানী ও পরমাণু চুল্লীর নিরাপত্তা রক্ষাসহ উচ্চ প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ‘পৃথিবীর বিরল ধাতু’ (আরইএম বা আরইই নামে পরিচিত) উৎপাদন বিশ্বব্যাাপী বাড়ছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ২০১৮ সালে বিরল ধাতু উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় যোগ দিয়েই রাশিয়া-ভারতকে পেছনে ফেলে দুই বছরের মধ্যে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ স্থানটি দখল করে নিয়েছে। তবে পৃথিবীর বিরল ধাতুসমূহের মোট মজুদের এক তৃতীয়াংশই ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশ পারমানবিক ক্লাবের সদস্য হতে যাচ্ছে। পাবনার রূপপুরে ২৪শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন যে দুটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে, সেগুলো চালু হলেই বাংলাদেশ প্রবেশ করবে এ ক্লাবে। আমদানীকৃত কাঁচামাল নির্ভর এ দুটো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীন কোন দ্বীপে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেরও প্রতিশ্রুত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর এসব পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিজস্ব কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
দেশের প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী, পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক ড. মীর কাশিম বলেন, ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের ৫৫০ কিঃমিঃ দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলে ভারি খনিজ বালি অনুসন্ধানে চালানো ভূ-তাত্ত্বিক জরিপে ১৭টি স্তুপের মধ্যে ৮টি মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। কক্সবাজার সৈকত ছাড়াও ইনানী, শাহপরীরদ্বীপ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কুয়াকাটা দ্বীপে এসব বালির স্তুপ রয়েছে।
গতবছর ৯ জানুয়ারি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্সডাইরেক্ট ডটকম-এ (গ্রাউন্ড ওয়াটার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর মুখপত্র) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ভূ-গর্ভস্থ মাটিতে থাকা জিরকন ও মোনাজাইটে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম থাকার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেসম্পদগুলো আহরণের জন্য সহজ ও টেকসই প্রযুক্তি হিসাবে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীকে কাজে লাগাতে পারি বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. কামাল হোসেন বলেন, সাগরলতার মাধ্যমে সৈকতে বালিয়াড়ি তৈরি হয়। আর বালিয়াড়িতে যদি মূল্যবান খনিজ থাকে, তার মানে সাগরলতাই সে সম্পদ ধরে আনছে। এভাবে প্রকৃতিতে থাকা আমাদের উদ্ভিদগুলোর বহুমুখী কার্যকারিতা যদি নিরূপণ করতে পারি, তাহলে একে কাজে লাগিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা লাভবান হতে পারি।
সাগরলতাকে ইংরেজিতে রেলরোড ভাইন বা রেলপথ লতা বলা হয়। রেলপথের মতোই যেন এর দৈর্ঘ। একটি সাগরলতা ১শ’ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea pes caprae উন্নত বিশ্ব সৈকতের পরিবেশগত পূনরুদ্ধারে সাগরলতার বনায়নের মাধ্যমে বালিয়াড়ি তৈরি করা হয়। তাদেরই দেখানো পথে কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগরে সাগরলতার বনায়নের মাধ্যমে বালিয়াড়ি তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন স্থানীয়রা। সুত্র: দৈনিক কক্সবাজার

পাঠকের মতামত