প্রকাশিত: ২৮/১২/২০২১ ১২:১৯ পিএম

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার::
কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে সরকারি ছুটি ও বিশেষ দিবসে দুই লক্ষাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে
কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে সরকারি ছুটি ও বিশেষ দিবসে দুই লক্ষাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার সবসময় পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এই শহরে প্রতি পর্যটন মৌসুমে সরকারি ছুটি ও বিশেষ দিবসে দুই লক্ষাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু এত পর্যটকের নিরাপত্তায় রয়েছেন মাত্র ২০৮ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ। লোকবল থেকে শুরু করে রয়েছে নানা অবকাঠামোগত সংকট। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চললেও এত অল্প সংখ্যক ট্যুরিস্ট পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে এবার প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটকরা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন জেলা ট্যুরিস্ট পুলিশের কর্মকর্তারা।

গত ২২ ডিসেম্বর স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে নারী পর্যটককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে কক্সবাজারের গুড ভাইব কটেজ রিসোর্টে অস্ট্রেলিয়ান নারীকে ধর্ষণচেষ্টা, ২০০৫ সালে বিদেশি নারীকে ধর্ষণের ঘটনা পর্যটকদের নিরাপত্তা ও ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে সমুদ্রসৈকত ঘিরে জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক পর্যটক।

খাতা-কলমে ২৫০, আছে ২০৮ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ

কক্সবাজার রিজিয়নে একজন পুলিশ সুপারের অধীনে ২৫০ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ খাতা-কলমে থাকলেও রয়েছেন ২০৮ জন। বাকি ৪২টি বিভিন্ন পদশূন্য। ফলে বিপুল পরিমাণ পর্যটককে সামাল দিতে এই বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে পর্যটকদের নিরাপত্তায় গঠন করা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ। সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানরত সৈকত পুলিশ ফাঁড়ি ভেঙে যুক্ত করা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশে। তখন থেকে কক্সবাজার উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ট্যুরিস্ট পুলিশকে একটি রিজিয়নে পরিণত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয় জনবল।

জেলায় ৩৫টি পর্যটন স্পট, কোন জোনের দায়িত্বে কতজন ট্যুরিস্ট পুলিশ

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রসৈকত ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ৩৫টি পর্যটন স্পট। এসব পর্যটন স্পটের বেশিরভাগ এলাকায় নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। বিশেষ করে সোনাদিয়া, মহেশখালী, খুরুশকুল, হিমছড়ি এলাকা সবসময় পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে। কিন্তু এসব পর্যটন স্পটে নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। নেই কোনও ট্যুরিস্ট পুলিশের ফাঁড়ি কিংবা নিরাপত্তা চৌকি। ফলে এসব এলাকার পর্যটকরা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন।

ফাইল ছবি

বর্তমানে কক্সবাজার শহরে ১৩৫, ইনানী সাব-জোনে ১৮, টেকনাফ সাব-জোনে ১৮, সেন্টমার্টিন সাব-জোনে ২১ ও ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক সাব-জোনে ১৬ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। তবে এর বাইরে একাধিক পর্যটন স্পট থাকলেও সেখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশের কার্যক্রম নেই।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটক আগমনের তুলনায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য অপ্রতুল। প্রতি মৌসুমে সরকারি ছুটি কিংবা বিশেষ কোনও দিবসে কক্সবাজারে পর্যটকদের আগমন বেশি ঘটে। শহরের সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে দুই লাখের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। এসব পর্যটক আবার ভাগ হয়ে সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট ভ্রমণ করেন। শুধুমাত্র কক্সবাজারের পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন ৫০০-৭০০ ট্যুরিস্ট পুলিশ।’

তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের সময় প্রতিটি জাহাজে দুই জন করে ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য মোতায়েন থাকে। এভাবে ইনানী, টেকনাফ ও ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন থাকে।

যেসব পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশ নেই

সোনাদিয়া, মহেশখালী, রামু, খুরুশকুল ও হিমছড়িসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশ নেই। এসব এলাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমেদ।

জনবল ছাড়াও ট্যুরিস্ট পুলিশের অবকাঠামোর উন্নয়ন দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্থ বরাদ্দের অভাবে বেশিরভাগ পর্যটন এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। তাই কোনও পর্যটক বিপদে পড়লে দূর-দূরান্ত থেকে গিয়ে দায়িত্ব পালন করা একজন পুলিশ সদস্যের পক্ষে সম্ভব হয় না।’


র্যটক আগমনের তুলনায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য অপ্রতুল
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কক্সবাজারের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পে ট্যুরিস্ট পুলিশের জন্য নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন কিংবা ঘর নির্মাণ করলে প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা দেওয়া সহজ হবে।’

যেসব সরঞ্জাম আছে ট্যুরিস্ট পুলিশের

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের রয়েছে জেট স্কি তিনটি, স্পিডবোট একটি, বিচ বাইক ১০টি, স্যান্ড সাপোর্ট দুটি, মোটরসাইকেল ২০টি, ট্রাক একটি, পিকআপ তিনটি, মাইক্রোবাস একটি ও জিপ একটি। দায়িত্ব পালন ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজে এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম

পর্যটকদের সহায়তায় পাঁচটি বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এগুলো হলো- পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভ্রমণ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা, পর্যটকদের আইনগত সহায়তা প্রদান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখা।

যেভাবে পর্যটকদের সহায়তা করে ট্যুরিস্ট পুলিশ

পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের সব তৎপরতাই পর্যটকদের কেন্দ্র করে। প্রথমত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে অবহিত করে, বিভিন্ন স্পটের তথ্য জানিয়ে দেয়, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায় এবং পদক্ষেপ নেয়, কোনও ধরনের সতর্কবার্তা থাকলে সেটি তাৎক্ষণিক পর্যটকদের অবহিত করে, পর্যটকদের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করে, কোনও ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়, কোনও পর্যটক অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে এবং সব ধরনের সহায়তা দেয়।

এর পাশাপাশি পর্যটন সম্পদ ধ্বংস প্রতিরোধ ও প্রত্নসম্পদ চুরি ঠেকাতেও কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। পর্যটকদের নানা সমস্যা সমাধান, হয়রানি রোধ, বখাটে ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রতিহত করতে প্রতিটি দর্শনীয় এলাকায় ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত থাকে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, আমাদের যেসব সরঞ্জাম আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমাদের ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অনুকূল পরিবেশে পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সহায়তা না পাওয়ায় অনেক সময় পর্যটকদের কিছু সমস্যা সমাধান করা যায় না। তবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে আমাদের পর্যটনশিল্পটা বিকশিত হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটনের উন্নয়নে ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণ, লজিস্টিক সাপোর্ট ও স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরা, সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রচারণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি, বিজ্ঞাপন সংস্থা যেসব বিলবোর্ড করছে, সেগুলো ট্যুরিস্ট পুলিশের অধীনে থাকা উচিত। এসব বিষয় মনিটরিং করতে জনবল ও অর্থের প্রয়োজন।’

পর্যটকদের নিরাপত্তায় যা যা দরকার ট্যুরিস্ট পুলিশের

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষ্যমতে, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তায় ওয়াচ টাওয়ার, রেসকিউ বোট, তথ্যকেন্দ্র, অফিস, মোটরবাইক, হেল্থ ও সহায়তা ডেস্ক তৈরি করা দরকার। আমাদের এসব নেই। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেল-মোটেলে অভিযান চালানোর জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া দরকার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- র‌্যাব এবং ঢাকা মেট্রোপলিটনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন।

একইভাবে ট্যুরিস্ট পুলিশেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সংযুক্ত করা দরকার। কারণ ট্যুরিস্ট পুলিশ বর্তমানে অভিযানে গেলে জেলা প্রশাসন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যায় না। এ কারণে গত দেড় বছরে কক্সবাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কোনও অভিযান চালাতে পারেনি ট্যুরিস্ট পুলিশ। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। এগুলো সমাধান করা জরুরি।’

শুধু পর্যটন মৌসুম নয়, মৌসুম ছাড়াও প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণের জন্য আসেন। সমুদ্রসৈকত ছাড়াও ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক, পাথুরে বিচ ইনানী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও রামুসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পর্যটকরা ভ্রমণ করেন। এসব এলাকায় পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন করা জরুরি। পাশাপাশি বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও ট্যুরিস্ট পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার দাবি পর্যটকদের।

এদিকে কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ রোড হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুখিম খান জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তায় আমরা সন্তুষ্ট। হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ট্যুরিস্ট পুলিশকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। সুত্র::বাংলাট্রিবিউন

পাঠকের মতামত

পুলিশ থেকে বাঁচতে জীবনটাই দিলেন সিএনজিচালক

গ্রামের চন্দনাইশে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে ...

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চলন্ত সিএনজিতে সিলিন্ডার বি’স্ফোরণ, চালক নিহত

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চন্দনাইশ এলাকায় চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুনে দগ্ধ হয়ে ...