এ যেন যুগ যুগের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেয়েছে, হাত দিয়ে আকাশের তারা যেন ধরতে পেরেছে কক্সবাজারবাসি। মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের এই সময়ে সবচেয়ে মূল্যবান ‘সোনার হরিণ’ জীবন বাঁচানোর যন্ত্র ‘আইসিইউ’ ও ‘এইচডিইউ’ উদ্বোধন হয়েছে কক্সবাজারে সদর হাসপাতালে।
আজকের পর থেকে করোনাক্রান্ত সংকাটাপন্ন কোন রোগীকে নিয়ে যেতে হবে না জেলার বাইরে। কক্সবাজারের কতো মানুষ একটি আইসিইউ বেডের জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তা একমাত্র কক্সবাজারের মানুষই স্বাক্ষী।
তবে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শনিবার (২০ জুন) সকাল ১১টায় অনলাইন জোম কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশেষায়িত ভেন্টিলেটরসমৃদ্ধ আইসিইউ ও এইচডিইউ’র ১৮টি বেড উদ্বোধন হয়েছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে।
কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা সদর হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাইমম সরওয়ার কমল এই আইসিইউ ও এইচডিইউ উদ্বোধন করেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে জোম কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজারের কৃতি সন্তান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কোভিড-১৯ এই সময়ে কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হেলালুদ্দিন আহমেদ, স্বাস্থ্য অদিপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক শাহরিয়ার কবির, আরআরআরসি মাহবুবুর রহমান তালুকদার, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান, ইউএনএইচসিআরের কক্সবাজার অফিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার শাখার সভাপতি ডা. পুচনু, সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান, সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাহান নাজির, কক্সবাজার প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চলনা করেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ও উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।
স্বপ্নের আইসিইও ও এইচডিইউ উদ্বোধন হলো কক্সবাজারে
উদ্বোধন হওয়া আইসিইউ ও এইচডিইউ’র ১৮টি বেড সম্পূর্ণ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের অর্থায়নে হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে শনিবার উদ্বোধন হলেও এই দিনেই রোগী ভর্তি করানো হবে না। আপাতত টায়াল শুরু হবে। আগামি ২১-২২ জুন থেকে বিশেষায়িত এই দুই ইউনিটে সংকাটাপন্ন রোগী ভর্তি নেয়া হবে।
চীনে যখন ‘কোভিড ১৯’ নামে অদৃশ্য একটি ভাইরাস কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিল। শত শত মানুষ মারা পড়ছিল। ঠিক তখনই ২৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রাণকেদ্র কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল চিন্তা করলো কক্সবাজারেই যদি করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হয়ে জটিল অবস্থায় পড়েন, তখন তাদের কিভাবে চিকিৎসা দেয়া হবে? আবার এই জেলার উপর ভর করে বসে আছেন আরও ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
সংক্রমণ ছড়ানো এই রোগ যদি পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারেই ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা সামাল দিতে বেগ পেতে হবে অনেক কঠিন মুহুর্তেও। যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অবনতি হয় কোন রোগীর অবস্থা, তখন উন্নত চিকিৎসা জন্য ১১/১২ ঘন্টা পেরিয়ে গাড়িতে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে রোগীকে!
বর্তমান পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ‘কোভিড ১৯’ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শরীরের পরিস্থিতির অবনতি হলে ‘আইসিইউ’ ইউনিটের প্রয়োজন হয়। কিন্তু গোটা কক্সবাজারের চিকিৎসা সেবায় একটিও অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ‘আইসিইউ’র ব্যবস্থা নেই। এই চিন্তা থেকেই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের সাথে যোগাযোগ করেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার এখনও অবকাঠামোগত জায়গায় অনেক পিছিয়ে। তাই কক্সবাজারকে এগিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) সহযোগিতায় ইউএনএইচসিআর বরাবর গত ২২ মার্চ একটি ‘রিকোয়েষ্ট’ লেটার পাঠান ডা. মহিউদ্দিন। সেই চিঠিতেই সাড়া পেয়ে যান তিনি।
করোনার এই কঠিন সময়ে মেডিকেলে ইকুয়েপমেন্ট দিতে উদ্যোগী হয় ইউএনএইচসিআর। সেই মতে প্রথমেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ১০ বেডের আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পূর্ণাঙ্গ নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট এবং ৮ বেডের হায় ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) স্থাপনের কথা থাকলেও সাথে ১০টি ‘ভেন্টিলেটর’ দাবি নিয়ে আদায় করে নেন তিনি। যেখানে বিশেষ ধরণের শয্যা, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটর, টিউব, পাম্প, হার্ট রেইট, ব্লাড প্রেসারসহ অন্যান্য শারিরিক পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক চিত্র পাবার মনিটরসহ নানা আধুনিক মেডিকেল সরঞ্জাম থাকবে।
ডা. মহিউদ্দিন বলেন, আরআরআরসির সহযোগিতায় যখন ইউএনএইচসিআরের সাথে চুক্তি হয়, তখন স্বাক্ষর করতে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের। চলমান করোনা পরিস্থিতির কঠিন সময় হওয়াতে জরুরি ভিত্তিতে অনেকটা রিস্ক নিয়েই আমি স্বাক্ষর করে চুক্তি সম্পাদন করেছি।
ইউএনএইচসিআরের সাথে চুক্তি অনযায়ী করোনাভাইরাস যতদিন থাকবে ততদিন ডাক্তার থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যয় বহন করবে তারা। যখন করোনা পরিস্থিতি শেষ হবে তখন সমস্ত ইকুইপমেন্ট রয়ে যাবে সদর হাসপাতালে। এখানেই সাধারণ জনগণ সেবা পাবেন।
স্বপ্নের আইসিইও ও এইচডিইউ উদ্বোধন হলো কক্সবাজারে
তিনি মনে করেন, আলহামদু লিল্লাহ, কক্সবাজারের মানুষ আর কষ্ট পাবেন না। ঢাকায় গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করতে হবে না। করোনা আক্রান্ত কেউ খারাপ হলেই তারা এই বিশেষায়িত ব্যবস্থায় চিকিৎসা নিবেন।
তিনি জানান, কক্সবাজার সদর হাসপাতালে করোনা রোগিদের জন্য পুরো একটি ফ্ল্যাট দেয়া হয়েছে। ওইখানে আইসোলেশন ওয়ার্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরাতন মেডিকেল কলেজ ভবনের ৫ম তলাতেই বসেছে ‘আইসিইউ’ ও ‘এইচডিইউ’ ইউনিট। এই ইউনিট দু’টো চালাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সব ধরণের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাপোর্ট দেবেন। পুরো ইনস্টুমেন্ট দেখভাল করবেন সদর হাসপাতালের এডমিনিস্ট্রেশন। তবুও ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে ওখানে নির্ধারিত ২ জন সিনির কনসালটেন্ট ও ৪ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট দেবে। যাদের আইসিইউতে ট্রেনিং আছে এমন ১০ জন ডাক্তারকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া দিয়েছে। এছাড়াও ট্রেনিং আছে এমন ২৫ জন নার্সকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মেডিকেল টেকনিশিয়ান ৩ জন, এম্ব্যুালেন্সের জন্য ড্রাইভার থাকবে ৩ জন, ওয়ার্ডবয় ১০ জন এবং ক্লিনার থাকবে ১০ জন। তাদের সমস্ত ব্যয় বহন করবে ইউএনএইচসিআর। সুত্র: সিভি