প্রকাশিত: ১৫/১২/২০২১ ৯:০৫ এএম , আপডেট: ১৫/১২/২০২১ ৯:৫৪ এএম

ক্রিকেটের মাঠের মতোই দেশের করপোরেট জগতে অবস্থান শক্তিশালী করেছেন সাকিব আল হাসান। ব্রোকারেজ হাউজ ও স্বর্ণ আমদানি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের পর এবার দেশের ব্যাংক খাতে যুক্ত হচ্ছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স প্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকা পিপলস ব্যাংকের দুটি পরিচালক পদের মালিকানা যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টার বয়ের হাতে। সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি তার মা শিরিন আক্তারও ব্যাংকটির পরিচালক হচ্ছেন। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে পিপলস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

দেশের সব ব্যাংকের প্রতি মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে হলে সমপরিমাণ অর্থই মূলধন হিসেবে জমা রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে হলে প্রয়োজন হয় সর্বনিম্ন ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের। সে হিসেবে পিপলস ব্যাংকের প্রতিটি পরিচালক পদের জন্য সর্বনিম্ন ১০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিতে হবে সাকিব আল হাসানকে। তবে ব্যাংকটির মালিকানায় আসতে তিনি ২৫ কোটি টাকারও বেশি মূলধন জোগান দিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

পিপলস ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা এমএ কাশেমও বণিক বার্তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, পিপলস ব্যাংকের মালিকানায় সাকিব আল হাসান ও তার মা যুক্ত হচ্ছেন। এরই মধ্যে আমরা তাদের ফাইল বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছি। সাকিবের মতো একজন তারকাকে উদ্যোক্তা হিসেবে পাওয়া আমাদের জন্য গৌরবের। এখনই আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে আমরা চূড়ান্ত লাইসেন্স পাব।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় বেঙ্গল কমার্শিয়াল, সিটিজেনস ও পিপলস নামে নতুন তিনটি ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক চলতি বছরের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। আর চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সিটিজেনস ব্যাংক। কিন্তু লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পিপলস ব্যাংক এখনো লাইসেন্স নিতে পারেনি।

পিপলস ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের অর্থের উৎসে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটিকে দেয়া এলওআই স্থগিত করা হয়েছিল। বিতর্কিত উদ্যোক্তাদের বাদ দিলে পিপলস ব্যাংকের এলওআইয়ের ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূলধনের অর্থ জমা দিতে পারেনি ব্যাংকটি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এলওআইয়ের মেয়াদ চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ হিসেবে চলতি মাসের মধ্যেই পিপলস ব্যাংক উদ্যোক্তাদের পরিশোধিত মূলধনের অর্থ জমা দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকটির এলওআই বাতিল হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী এমএ কাশেম যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের এ বাসিন্দা ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়ে আবেদনের পর থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে তিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা হতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তাদের বেশির ভাগই ছিটকে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান ও তার মা শিরিন আক্তার এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। চূড়ান্ত লাইসেন্স পেলে এটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের। এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন তিনি। স্বর্ণ আমদানি ও বিপণন, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে তার। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে বছর দুয়েক ধরে দেশের পুঁজিবাজারের বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছেন সাকিব। বড় অংকের অর্থ লগ্নি করেছেন তিনি। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শুভেচ্ছাদূত সাকিব আল হাসান চলতি বছরের মে মাসে একটি ব্রোকারেজ হাউজের অনুমোদনও পেয়েছেন। দেশে বৈধভাবে স্বর্ণবার ও স্বর্ণালংকার আমদানি এবং বিক্রির জন্য ‘বুরাক কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ কোং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও নিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের মাঠ ছাপিয়ে করপোরেট জগতের বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন সাকিব আল হাসান।

২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যবসার জগতে পা রাখেন সাকিব আল হাসান। বিভিন্ন খাতে একের পর এক বিনিয়োগ করেছেন তিনি। তবে ব্যাট-বল হাতে সাকিবের যে সাফল্য, তা ধরা দেয়নি ব্যবসায়। দেশে তার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রুগ্ণ। কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন।

কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের শিকলবাহায় ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ডুয়াল-ফুয়েলভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে আবেদন করে সাকিব আল হাসানের কনসোর্টিয়াম। এনইএল-আরএমএল-এসএনইপিএসসিএল এনার্জি কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দেয় বিপিডিবির কাছে। চুক্তি স্বাক্ষরের দেড় বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

বিপিডিবির কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অনুমোদিত প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো চিঠিতে সাকিব আল হাসান নিজেই সই করেন। চিঠিতে কনসোর্টিয়ামটির প্রধান কার্যালয় দেখানো হয় রাজধানীর প্রগতি সরণির রূপায়ণ মিলেনিয়াম স্কয়ার। যদিও আবেদনপত্রটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় বিপিডিবি সেটি ফেরত দেয়। এরপর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে করার জন্য দেশের একাধিক বড় শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। তবে এটি এখনো বিপিডিবিতে আবেদিত অবস্থায় রয়েছে।

রাজধানীর বনানীতে সাকিব’স ডাইনস নামে একটি রেস্টুরেন্ট করেন সাকিব আল হাসান। ২০১৫ সালে রেস্টুরেন্টটির উদ্বোধন করা হয়। যদিও কিছুদিন পরই রেস্টুরেন্টটি বিক্রি করে দেন তিনি। বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর ও ধানমন্ডিতে ‘সাকিব’স-৭৫’ নামে দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।

২০১৬ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালীতে ১৪ একর জমির ওপর কাঁকড়া ও কুঁচের খামার গড়ে তোলেন সাকিব আল হাসান। তবে প্রায় দুই বছর ধরে সাকিব এগ্রো ফার্ম লিমিটেড নামের খামারটি বন্ধ রয়েছে।

স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের আগ্রহে প্রসাধনী ব্যবসায়ও নেমেছিলেন সাকিব আল হাসান। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে কসমিক জোভিয়ান নামে একটি কসমেটিকস শপ উদ্বোধন করেন সাকিব। যদিও কাঁকড়ার খামারের মতোই বন্ধ রয়েছে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের কসমেটিকস বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটিও।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফিয়েস্তা নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাকিব আল হাসান। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা হলেও সাকিব সেটির সঙ্গে যুক্ত হন ২০১৫ সালে। প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জন পরিচালকের মধ্যে সাকিব আল হাসান চেয়ারম্যান ও নকীব চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

২০১৮ সাল-পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার সৌদি আরব সফরে যান সাকিব আল হাসান। সাকিবের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, ওমরাহ করার কথা বলে সৌদি গেলেও এক্ষেত্রে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা সম্প্রসারণ। ওই সময় সাকিব সৌদি আরবে একাধিক আবাসিক হোটেল কেনেন। মূলত ওমরাহ করতে যাওয়া বাংলাদেশীদের কাছে ভাড়া দিতেই হোটেলগুলো কেনা হয়েছিল। এ ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে ‘সাহ-৭৫ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি উদ্বোধন করেন সাকিব। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের হোয়াইট স্যান্ড রিসোর্ট হোটেল কাম শপিং মলে ২০ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস কেনারও চুক্তি করেন সাকিব।

২০১৭ সাল থেকে বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাকিব আল হাসান। চলতি বছরের মে মাসে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে তার মালিকানাধীন মোনার্ক হোল্ডিংস। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেয়া নথিতে দেখা যায়, মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান পদে নাম রয়েছে সাকিব আল হাসানের। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী ও সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হীরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান। আর পরিচালক হিসেবে জাভেদ এ মতিন ও আবুল কালাম মাতবরের নাম রয়েছে।

২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো স্বর্ণ নীতিমালা অনুমোদন দেয় সরকার। ওই নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ১৮টি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ব্যাংককে অনুমোদিত গোল্ড ডিলার হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো সাকিব আল হাসানের ‘বুরাক কমোডিটিজ এক্সচেঞ্জ কোং’। ঢাকা, রংপুর ও কুমিল্লায় কার্যালয় খুলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। বিদেশ থেকে সোনার বার ও সোনার অলংকার আমদানিও শুরু করেছে বুরাক কমোডিটিজ।

২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলছেন সাকিব আল হাসান। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট, বিগ ব্যাশ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, শ্রীলংকান প্রিমিয়ার লিগ, পাকিস্তান সুপার লিগসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই খেলছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশী বিভিন্ন লিগে খেলে বিপুল পরিমাণ আয় করেছেন সাকিব আল হাসান। উপার্জিত অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন খাতেও বিনিয়োগ করেছেন সাকিব। দেশটির উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে বাড়ি কিনেছেন তিনি।

পিপলস ব্যাংকে বিনিয়োগ নিয়ে সাকিব আল হাসানের বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যক্তিগত সেলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। সুত্র : বণিক বার্তা

পাঠকের মতামত