এএইচ সেলিম উল্লাহ
কক্সবাজারের উখিয়ায় বনের জমি দখল করে গড়ে তুলছে দেশি-বিদেশি সংস্থাও (এনজিও, আইএনজিও) অফিস। যার ফলে দখল হয়ে যাচ্ছে হাজারো একর সরকারি বনভূমি। ইতিমধ্যে ছয় এনজিওকে নোটিশ দিয়েছে বন বিভাগ। গত কয়েকদিন ধরে উখিয়ার মধুরছড়া এলাকায় ডব্লিউএফপির অফিসের অবকাঠামো নির্মাণ কাজে করে আসছিল।
মঙ্গলবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বনবিভাগ এতে বাঁধা দেন। এতে ডব্লিউএফপির মাঠকর্মীরা বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ান।
অন্যদিকে বনবিভাগের নোটিস ও আইনের তোয়াক্কা না করে এসব সংস্থা অফিস, ওয়্যারহাউস ও স্থাপনা গড়ে তুলেছে। অথচ এই জমি যদি সরকার লিজ দিত, বছরে শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো। পক্ষান্তরে কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে দখলবাজ সিন্ডিকেটের হাতে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়ার বনভূমি দখলের নেপথ্যে এনজিও-আইএনজিও সিন্ডিকেট। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি বনভূমি খুলে দেওয়া হয়। কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হাজার একর বন কেটে আশ্রয়স্থল, বাজার ও দোকানপাট গড়ে ওঠে। সেই সময়কে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থা বনভূমিতে অফিস স্থাপন শুরু করে। ওয়ালাপালংয়ের মুহুরীপাড়া এলাকায় বনের বিশাল অংশ দখল করে স্থাপনা করেছে মাইশা এন্টারপ্রাইজ। কোম্পানির ম্যানেজার রাশিক খান নিজের দাপটে স্থানীয়দের প্রবেশও সীমিত করেছেন। এমনই দৃশ্য মধুরছড়া, কুতুপালং, ফলিয়াপাড়া ও বিভিন্ন এলাকায়। কোথাও গড়ে উঠেছে বিশাল ওয়্যারহাউস, কোথাও অফিস, কোথাও আবার পশুখামারের আড়ালে প্রকল্প চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তারা সরকারের আদেশ-নির্দেশও মানছে না। সরকারের নোটিস অমান্যের পাশাপাশি তারা অহরহ আইন ভেঙে দাপট দেখিয়ে চলেছে।
২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জ অফিস থেকে ব্র্যাক, ডব্লিউএফপি, আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ ছয়টি এনজিও-আইএনজিওকে নোটিস দেওয়া হয়। নোটিশে ছয় কর্মদিবসের মধ্যে বৈধ কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সংস্থাই জবাব দেয়নি। বরং তারা আগের মতোই দখল করা স্থাপনায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো.আবদুল মান্নান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আরও জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফের এলাকাটি এখন পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠেছে। অথচ পাহাড়ি বনভূমি একসময় হাতি, হরিণ, বন্যশূকরসহ অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থল ছিল। এখন দখলকৃত এলাকায় সড়ক কাটা হয়েছে, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে, বড় বড় স্থাপনা তৈরি হয়েছে। ফলে বন্যপ্রাণী তাদের স্বাভাবিক আবাস হারাচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়ান হাতির করিডোর বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বন সংকোচনের কারণে হাতি মানুষের বসতিতে প্রবেশ করছে, বাড়ছে মানুষ-হাতি সংঘাত।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এই দখলকৃত কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে এবং উখিয়া-টেকনাফের পরিবেশ চিরতরে ধ্বংস হবে।
অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের অবস্থান ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় বনভূমি এখন বন্যপ্রাণীর জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, এনজিও-আইএনজিওগুলোকে নোটিস দেওয়া হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। এখন আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
এদিকে স্থানীয়দের মতে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও আন্তর্জাতিক দাতাদের ছত্রছায়ায় এনজিও-আইএনজিওর এসব দখল কার্যক্রম চলছেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি আইনি প্রক্রিয়ায় বনভূমি ইজারা দিত, তবে বছরে কয়েকশ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু এখন অবৈধ দখলদাররা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, সরকার পাচ্ছে না কিছুই। তাদের মতে, দখলকৃত এলাকা জরিপ করে চিহ্নিত করতে হবে। এনজিও-আইএনজিওর সব কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিকল্প জমিতে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। দখলবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলাকাবাসীর মতে, উখিয়া-টেকনাফের বনভূমি শুধু রোহিঙ্গা সংকটেই নয়, এনজিও-আইএনজিও, স্থানীয় সিন্ডিকেটের দখলদারিতেও ধ্বংসের পথে। সরকারি নোটিস অগ্রাহ্য করে যারা বনের জমি ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। আইন প্রয়োগ করা না হলে উখিয়ার বনভূমি শুধু বিলীনই হবে না, হারাবে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য। আর কোটি কোটি টাকা বেহাত হবে সিন্ডিকেটের হাতে, যা দেশের রাজস্ব খাতের জন্য বড় ক্ষতি।
মঙ্গলবারের অভিযান প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে উখিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নান বলেন, সংরক্ষিত বনের জমিতে ডব্লিউএফপি স্থাপনা নির্মাণ করে আসছিল। খবর পেয়ে সোমবার কাজ বন্ধ করে দিই। পুনরায় মঙ্গলবার কাজ শুরু করলে খবর পেয়ে বনবিভাগ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে এবং কাজ না করতে বাঁধা দিলে আমাদের সাথে (বনবিভাগ) বাকবিতন্ডায় জড়ান।
তিনি আরো জানান, বিষয়টি উপরি মহলকে অবহিত করা হয়েছে। এবং কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কক্সবাজার শহর শাখার সভাপতি ইরফান উল হাসান বলেন, কক্সবাজারের নাজুক পরিবেশ, পাহাড়-জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর উপর যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণের ফলে পাহাড় ধস, বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর বিচরণ ব্যাহতসহ জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব আরো বাড়বে। তাছাড়া বনভূমি কোনো সংস্থার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়; এটি রাষ্ট্রের সম্পদ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের সুরক্ষা কবচ। উন্নয়ন বা মানবিক কার্যক্রমের নামে বন ধ্বংস ও দখল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।