প্রকাশিত: ০৯/১১/২০২১ ৫:৪৫ পিএম

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অপরাধ দমনে যেমন উন্নতি ঘটেছে তেমনি অপরাধীদের মধ্যেও বেড়েছে বিকল্প পন্থার ব্যবহার। টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী এলাকা হয়ে নৌপথে পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা। সম্প্রতি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আসছে ভয়ঙ্কর মাদক আইসও (ক্রিস্টাল মেথ)। এজন্য মাদক-কারবারিরা ব্যবহার করছেন মিয়ানমারের সিম এমপিটি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি) এর সিম ব্যবহারের কারণে মাদক-কারবারিদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও রোমিং করে ব্যবহার করা যাচ্ছে এমপিটি সিম। এছাড়া নিজস্ব যানবাহনে করে ডিলার ও গ্রাহকদের বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে আইস ও ইয়াবা। কখনও আচার, কাপড়; আবার কখনও চায়ের প্যাকেটের আড়ালে টেকনাফ থেকে আইসের চালান ঢুকছে ঢাকায়।

সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে সর্ববৃহৎ পাঁচ কেজি আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) চালানসহ টেকনাফকেন্দ্রিক এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মো. হোছেন ওরফে খোকন এবং তার সহযোগী মোহাম্মদ রফিককে আটক করেন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বিদেশি অস্ত্র ও গুলি। পাওয়া যায় মিয়ানমারের সিম এমপিটি।

মিয়ানমারের এমপিটি সীমসহ আটক ৩ রোহিঙ্গা

অন্যদিকে, রাজধানীর উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায় গত ১৭ ও ১৮ অক্টোবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একাধিক টিম যৌথ অভিযান চালায়। অভিযানে ক্রিস্টাল মেথ (আইস) উদ্ধারসহ জহিরুল ইসলাম সুমন (৪০), নুরুল ইসলাম (৩৩) ও মেজবাহ উদ্দিন ইমন (৩৩) নামের তিন মাদক-কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ৫০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস)।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতার তিনজনই দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবার কারবারে জড়িত। সম্প্রতি তারা আইসের কারবার শুরু করে। মিয়ানমারে তাদের ছিল নিয়মিত যাতায়াত। টেকনাফ সীমান্তে নিজেদের নিরাপত্তায় ব্যবহার করতেন এমপিটি সিম।

এর আগে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে, মিয়ানমারের মংডু সীমান্তসহ আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে মোবাইলের ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার। এমপিটি নামের একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের টাওয়ার বসিয়ে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড সিম পাঠাচ্ছে তারা।

ইয়াবাসহ বাংলাদেশের জন্য ‘হুমকি’— এমন সবকিছুর ডিল (লেনদেন) হচ্ছে এমপিটির ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে। মূলত বাংলাদেশের মাদক-কারবারিরা এসব সিম ব্যবহার করছেন। তারা এ সিমের মাধ্যমে মিয়ানমারে থাকা মাদক-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এসব ফোনকল কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া সীমান্তে টাওয়ার স্থাপনের ফলে খুব সহজেই বাংলাদেশের অনেক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার।

এমপিটি সিমের ব্যবহার জানে প্রশাসন

মিয়ানমার সীমান্তে এমপিটি সিমের ব্যবহার এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব বিভাগ এ সিমের ব্যবহার ও বিক্রির বিষয়ে জানে। সম্প্রতি র‌্যাবের অভিযানে এমপিটি সিম জব্দের আগেও গত বছরের ১৪ জুন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে ৪০টি এমপিটি সিম জব্দ করা হয়।

এর আগেও বিভিন্ন সময় এমপিটি সিম উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের বক্তব্য হলো- চোরাচালানের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে এমপিটি সিম কার্ডগুলো আনা হয়। এগুলো মূলত মাদক-কারবারিরা ব্যবহার করেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেকনাফে হ্নীলা ইউনিয়নে র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরুল আমিন (৪৩) নামে এক রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হন। ওই ডাকাতের ব্যাগ থেকে র‍্যাব ১১টি এমপিটি সিম উদ্ধার করে। এছাড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের এইচ ব্লকে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে রোহিঙ্গা ডাকাত জিয়াউর রহমানকে। তার কাছেও মেলে এমপিটি সিম।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অর্ধশতাধিক ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে নয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে তারা ডাকাতির আগে যোগাযোগের জন্য এমপিটি সিম ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন।

কেন এমপিটি সিমের ব্যবহার

মাদক-কারবারিরা কেন এবং কীভাবে এমপিটি সিম ব্যবহার করছেন— জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার আইস-কারবারি হোছেন ওরফে খোকন টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা। কাপড়, আচার বা চা আমদানির আড়ালে সে মিয়ানমার থেকে আইস নিয়ে আসত। দেশটিতে অবৈধ যাতায়াত ছিল তার। আইস-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সীমান্তবর্তী নদীপথ বা মিয়ানমারের সিম এমপিটি ব্যবহার করত খোকন।’

টেকনাফে কীভাবে এ সিম ব্যবহার হয়— জানতে চাইলে খন্দকার মঈন বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে খোকন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। তবে, কয়েক মাস হলো সে আইসের চালান আনা শুরু করে। তার সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক-কারবারিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সে এমপিটি সিম ব্যবহার করে।’

‘টেকনাফে সে এমপিটি সিম ব্যবহার করত কি না— সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে, মিয়ানমারে যাতায়াত এবং সেখানকার মাদক-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এমপিটি সিম নিরাপদ মনে করত খোকন।’

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মাঝের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে আসছে ইয়াবা ও আইসের চালান। মালবাহী বোটে আসা মাদকের এ চালান নিরাপদে খালাস করতে ব্যবহার হচ্ছে লাইট সিগন্যাল। সিগন্যাল পেলে বোট ভিড়িয়ে খালাসের পর তা টেকনাফের বিভিন্ন বাসায় মজুত করা হয়। এরপর আচার বা চায়ের প্যাকেট অথবা বার্মিজ কাপড়ের প্যাকেটের আড়ালে সেগুলো ঢাকায় আনা হয়।

চট্টগ্রাম হয়ে বিভিন্ন যানবাহন ছাড়াও ব্যক্তিগত বাহনে ঢাকার উত্তরা, বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে তাদের সিন্ডিকেট সদস্য ও ডিলারদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আইস ও ইয়াবার চালান।

হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন, ধরা পড়লে টাকা মাফ

মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ও আইসের চালানের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে সেখানকার মাদক-কারবারিদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। র‍্যাবের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আইসের চালান যদি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তাহলে মিয়ানমারের কারবারিরা তার দাম নেয় না । নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর হুন্ডির মাধ্যমে আইসের চালানের দাম পাঠানো হয় মিয়ানমারে। বাংলাদেশি মাদক-কারবারিদের উৎসাহিত করতে অগ্রিম টাকা ছাড়াই আইসের চালান পাঠায় তারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে মাদকবিরোধী অভিযানে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, মিয়ানমারে থাকা মাদক-কারবারিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয় তাদের। এজন্য তারা এমপিটি সিম ব্যবহার করেন।

কক্সবাজারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মূলত টেকনাফকেন্দ্রিক মাদকের চোরাচালান হচ্ছে। সেখানে মাদক-কারবারিদের নজরদারি করাটা কঠিন। কারণ, তারা অবৈধভাবে বিদেশি সিম (এমপিটি) ব্যবহার করে। এ সিমের ব্যবহার কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম সাহিদুজ্জামা বলেন, এক দেশের নেটওয়ার্ক অন্য দেশে প্রবেশ এবং তা ব্যবহারের কোনো বৈধতা নাই। এটা ক্রস বর্ডার ইস্যু। আমাদের দেশে ওদের (মিয়ানমার) ফ্রিকোয়েন্সি, এটা তারা করতে পারেন না। আমরাও তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারি না। আইপিও রুলস আছে। যেখানে মিয়ানমার ও আমরা স্বাক্ষর করেছি।

‘এরপরও যেহেতু ঘটছে সেজন্য বাংলাদেশ সীমান্তে এমপিটির ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার বন্ধে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা ফরেন মিনিস্ট্রিকে জানিয়েছি। এটা সরকার টু সরকার, মিনিস্ট্রি টু মিনিস্ট্রি যোগাযোগের মাধ্যমে সমাধানে আসা যেতে পারে। পাশাপাশি কারা সীমান্তে অবৈধ পন্থায় এমপিটি সিম ব্যবহার করছেন তা খতিয়ে দেখে অভিযান পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট সীমান্তবর্তী এলাকার নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সূত্র-ঢাকাপোস্ট।

পাঠকের মতামত

উখিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই – জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর বিবৃতি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রেক্ষাপটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বিবৃতি দিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ...