প্রকাশিত: ০৩/০৬/২০২২ ৯:০০ এএম

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ইতোমধ্যে ৬৫ লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু দেশ ছেড়েছে। মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত। এতে করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আসা শরণার্থী সংকট বাড়িয়ে তুলেছে।

তারও আগে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর ইতোমধ্যে দেশটির ভেতরে ও বাইরে লাখ লাখ আফগান বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ফলে ওদিকেও আরেকটি মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শরণার্থীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে।

২০১৭ সালে যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন শুরু করে, তখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর সঙ্গে প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু যোগ হচ্ছে। কভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দুর্দশা ক্রমেই বাড়ছে। নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সেদিক থেকে রোহিঙ্গারা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নিপীড়নের ভয়ে একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফিরে যায়নি। দেখা যাচ্ছে, অন্য দেশে নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর ভয়াবহ মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ওদিকে রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো শুরু থেকে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শরণার্থীদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে দাতা সংস্থাসহ উন্নয়ন অংশীদারদের রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ সাহায্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যেন বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। দাতা সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় শেখ হাসিনা সরকারের শুধু প্রশংসাই করে যাচ্ছে; কিন্তু সংকটের সমাধান এবং শিবিরে আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতায় ততটা সক্রিয় হচ্ছে না।

প্রত্যাবাসন ঘিরে অস্পষ্টতার কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও স্বভাবতই হতাশ হয়ে পড়ছে। যদিও বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনেকেই একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তীব্র নিন্দা করেছে। রোহিঙ্গাদের এমন পরিস্থিতি উপেক্ষা করা উচিত নয়। বিশ্ববাসী যেন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে; তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে চায়, তবে বাস্তবতা হচ্ছে এখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি সবচেয়ে টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। যাহোক, মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থাহীনতার কারণে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে ব্যর্থ হয়।

মিয়নমারকে নিশ্চিত করতে হবে, স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের প্রত্যাবর্তনের সময় যাতে নির্যাতিত না হয়। এই লক্ষ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের চাপ বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও দৃঢ় কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করা উচিত। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো যেন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ভুলে না যায়।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, ইউক্রেনের বিপর্যয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সময় তাঁদের বিশ্বের অন্যান্য চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি, যেমন- রোহিঙ্গা সংকটের কথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না বরং এদিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সহায়তা প্রয়োজন। তারা গত পাঁচ বছর তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে বলেছে এবং একই গল্প পুনরাবৃত্তি করেছে। বিনিময়ে তারা সমবেদনা আর ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পায়নি। ইউক্রেনের অভিবাসীদের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় আমরা আশা করি, বিশ্ব বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর দুর্দশাকে উপেক্ষা করবে না। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আবেদন অবশ্যই জোরে, আরও দৃশ্যমান এবং আরও ঘন ঘন হওয়া উচিত।

মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার তাদের আছে, কারণ তারাও মানুষ। তবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনই চূড়ান্ত সমাধান। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তাদের টিকে থাকতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে, তাদের ভুলবেন না দয়া করে।

লেখক : মো. আজম সারওয়ার চৌধুরী

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...