উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬/১০/২০২২ ৮:২৪ পিএম

নাটক-সিনেমা গান আর সামাজিক মাধ্যমে আমরা ডুবে আছি। যাপিত জীবনে এখন তারকারা আমাদেরই জীবনের অংশ। তাদেরকে আইডল মেনে, মনে মনে কামনা করে চলছে আমাদের জীবন। এমনকি তৈরি হয়েছে ‘ক্রাশ’। লাস্যময়ী, সুন্দরী কোনো তারকা মানেই তরুণ ও যুবকদের ক্রাশ। অন্যদিকে হ্যান্ডসাম সুদর্শন তারকারাও যুবতী ও তরুণীদের ক্রাশ।
এই ক্রাশের আবির্ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে রাসুল (সা.) এর সাবধানতার কথা। কেননা বেগানা নারীকে পাওয়ার আকাঙ্খাকে যিনা হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন মহানবী (সা.)।

হাদিস শরীফে এসেছে-
حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنِ ابْنِ طَاوُسٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ لَمْ أَرَ شَيْئًا أَشْبَهَ بِاللَّمَمِ مِنْ قَوْلِ أَبِي هُرَيْرَةَ‏.‏ حَدَّثَنِي مَحْمُودٌ أَخْبَرَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ أَخْبَرَنَا مَعْمَرٌ عَنِ ابْنِ طَاوُسٍ عَنْ أَبِيهِ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَا رَأَيْتُ شَيْئًا أَشْبَهَ بِاللَّمَمِ مِمَّا قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم “‏ إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَا، أَدْرَكَ ذَلِكَ لاَ مَحَالَةَ، فَزِنَا الْعَيْنِ النَّظَرُ، وَزِنَا اللِّسَانِ الْمَنْطِقُ، وَالنَّفْسُ تَمَنَّى وَتَشْتَهِي، وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ كُلَّهُ وَيُكَذِّبُهُ ‏”‏‏.

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নবী (সা.)বলেছেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা বানী আদামের জন্য যিনার একটা অংশ নির্ধারিত রেখেছেন। সে তাতে অবশ্যই জড়িত হবে। চোখের জিনা হলো দেখা, জিহ্বার জিনা হলো কথা বলা, কুপ্রবৃত্তি কামনা ও খাহেশ সৃষ্টি করা এবং যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে। [মুসলিম ৪৬/৫, হাঃ ২৬৫৭, আহমাদ ৮২২২]

আল্লামা খাত্তাবী (রহ.) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ‘‘দেখা ও কথা বলাকে যিনা বলার কারণ এই যে, দু’টোই হচ্ছে প্রকৃত যিনার ভূমিকা- যিনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর। কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্বোধক আর জিহবা হচ্ছে বাণী বাহক, যৌনাঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার- সত্য প্রমাণকারী।’’ মা‘আলিমুস সুনান ৩য় খন্ড ২২৩ পৃষ্ঠা)

হাফিয আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেনঃ‘‘দৃষ্টিই হয় যৌন লালসা উদ্বোধক, পয়গাম বাহক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌন অঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদস্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই হচ্ছে তার সর্ব কিছুর মুল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়, আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে, আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে, আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোন বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোন উপায় থাকে না।’’ আল-জাওয়াব আলকাফী, পৃষ্ঠা ২০৪)

এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি চালনার কুফল সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে নাবী কারীম ﷺ ইরশাদ করেছেনঃ النظرة سهم مسموم من سهام ابليس

‘‘অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি ইবলীসের বিষাক্ত বাণ বিশেষ।’’ মুসনাদ আশশিহাব ১মখন্ড ১৯৫-১৯৬ পৃষ্ঠা)

আল্লামাহ ইবনে কাসীর (রহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃالنظرة سهم سم إلى القلب

‘‘দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীর, যা মানুষের হৃদয়ে বিষের উদ্রেক করে।’’ ইবনু কাসীর ৩য় খন্ড ৩৭৬ পৃষ্ঠা)

এ দু’টো যেমন আলাদা আলাদা নির্দেশ, তেমনি প্রথমটির অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শেষেরটি অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হলেই লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সম্ভব। অন্যথায় তাকে চরম নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হতে হবে নিঃসন্দেহে।

আকস্মিকভাবে কারো প্রতি চোখ পড়ে যাওয়া আর ইচ্ছাক্রমে কারো প্রতি তাকানো সমান কথা নয়। প্রথমবার যে চোখ কারো উপর পড়ে গেছে, তার মূলে ব্যক্তির ইচ্ছার বিশেষ কোন যোগ থাকে না; কিন্তু পুনর্বার তাকে দেখা ইচ্ছাক্রমেই হওয়া সম্ভব। এ জন্যেই প্রথমবারের দেখায় কোন দোষ হবে না; কিন্তু দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ তুলে তাকানো ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষত এ জন্য যে, দ্বিতীয়বারের দৃষ্টির পিছনে মনের কলুষতা ও লালসা পংকিল উত্তেজনা থাকাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের দৃষ্টি দিয়ে পরস্ত্রীকে দেখা স্পষ্ট হারাম।

তার মানে কখনো এ নয় যে, পরস্ত্রীকে একবার বুঝি দেখা জায়েয এবং এখানে তার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আসলে পরস্ত্রীকে দেখা আদতেই জায়েয নয়। এজন্যেই কুরআন ও হাদীসে দৃষ্টি নত করে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রসূলে কারীম ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলঃ ‘পরস্ত্রীর প্রতি আকস্মিক দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে আপনার কী হুকুম? তিনি বললেনঃ اصرف بصرك ‘‘তোমার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও।’’ আবূ দাউদ ২১৪৮, সহীহ আলবানী)

দৃষ্টি ফেরানো কয়েকভাবে হতে পারে। উদ্দেশ্য হচ্ছে পরস্ত্রীকে দেখার পংকিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা। আকস্মিক নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি কারো প্রতি দৃষ্টি পড়ে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নীচু করা, অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ঈমানদার ব্যক্তির কাজ।

নাবী কারীম ﷺ একবার নিকটে উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘‘মেয়েলোকদের জন্য ভাল কী?’’

প্রশ্ন শুনে সকলেই চুপ মেরে থাকলেন, কেউ কোন জবাব দিতে পারলেন না। ‘আলী এখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বাড়ি এসে ফাতিমা -কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেনঃ لا يراهن الرجال ভিন্ পুরুষরা তাদের দেখবে না। এটাই তাদের জন্যে ভাল ও কল্যাণকর)।

অপর বর্ণনায় ফাতিমা বললেনঃ لا يرين الرجال ولا يرون هن মেয়েরা পুরুষদের দেখবে না, আর পুরুষরা দেখবে না মেয়েদেরকে। দারকুতনী, বাযযার)

বস্ত্তত ইসলামী সমাজ জীবনের পবিত্রতা রক্ষার্থে পুরুষদের পক্ষে যেমন ভিন্ মেয়েলোক দেখা হারাম, তেমনি হারাম মেয়েদের পক্ষেও ভিন্ পুরুষদের দেখা। এ কথার যথার্থতা বোঝা যায় এ দিক দিয়েও যে, গায়র-মুহাররমের প্রতি তাকানো হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে যৌন বিপর্যয়ের ভয়। আর মেয়েদের ব্যাপারে এ ভয় অনেক বেশী। কেননা যৌন উত্তেজনা যেমন মেয়েদের বেশী, সে পরিমাণে বুদ্ধিমত্তা তাদের কম। আর পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কারণেই অধিক যৌন বিপর্যয় ঘটে থাকে।’’ নাইলুল আওত্বর ৬ষ্ঠ খন্ড ১৭৭ পৃষ্ঠা)

এখন ভাবুন, আমাদের সমাজ ও মিডিয়া যেগুলো ক্রাশ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরছে সেগুলো আসলে কী? তাই নফসের প্রলোভনে পড়বেন না। সর্বদা ঈমান-আমল নিয়ে বাঁচুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দৃষ্টি হেফাজত করার তাওফিক দান করুক। আমিন

পাঠকের মতামত