নিউজ ডেস্ক::
ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর সম্মেলনে দুই ইস্যুতে সরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ। এগুলো হচ্ছে- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। ওই ২ ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করাই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। গত ২ দিনে আইপিইউ-এর বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক ও সাধারণ আলোচনায় এ নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের ১৭ সদস্যর
প্রতিনিধি দল। এর বাইরে বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়েও ২টি বিষয় তুলে ধরছেন তারা। আইপিইউ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া। এ প্রসঙ্গে গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, ১৯৭১ সালে পকিস্তানিরা বাংলাদেশিদের ওপর কি ধরনের নির্যাতন করেছে তা বিশ্ববাসীকে জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। তারা এখনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা আসা একটি অন্যতম সমস্যা বলে মনে করছে বাংলাদেশ। এ নিয়েও বিশ্বকে জানানো প্রয়োজন। একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য মুহাম্মদ ফারুক কান বলেন, বাংলাদেশের দুটি সমস্যা পৃথিবীর মানুষকে জানানো আমাদের উদ্দেশ্য। একটি দেশের ওপর চালানো গনহত্যার যে কি কষ্ট তা আমরা তুলে ধরেছি। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমাদের কথা প্রতিনিধিরা শুনেছেন। আমাদের সঙ্গে একই মতামত জানিয়েছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক
এদিকে সম্মেলনের তৃতীয় দিনে অংশগ্রহণমূলক বিতর্কে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে আইপিইউ’র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারপার্সন বি তিশিরিলেস্ত-এর সভাপতিত্বে এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী বিতর্কে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে দেশে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ নিয়ে চুক্তি ও সমঝোতা কাজে আসছে না বলে দাবি করা হয়েছে। আলোচনায় গণহত্যার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। এ সকল বিষয়ে আইপিইউ’র সংসদগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। আজও এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্র ধ্বংসের চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় বিগত নির্বাচনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নির্বাচন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জও ছিল, যা মোকাবিলা করে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। ওই সফলতার কারণে আইপিইউ সম্মেলনের মতো এই বৃহৎ আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। বিরোধী দলীয় ওই সদস্য বলেন, বাংলাদেশ সব সময়ই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক। আমরা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হই। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশব্যাপী গণহত্যা চালানো হয়। যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধি আজম আলহমদ। তিনি বলেন, গাঁজার প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। সেখানে গণহত্যা চললেও এনিয়ে জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভূমিকার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আইপিইউ কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, মানবাধিকার বিষয়ক অনেক আইন থাকলেও উন্নয়নশীল তা মেনে চলছে না। মানবাধিকার নিয়ে নানা চুক্তি ও সমঝোতা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দুর্বল গণতন্ত্রের কারণে সেখানে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করে উগান্ডার প্রতিনিধি বলেন, আমরা মুখে বড় বড় কথা বলছি। কিন্তু বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে। নারীদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অনেকে পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছেন না। কেনিয়ার প্রতিনিধি ইয়োকে ইথোরো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কেনিয়াতে শক্তিশালী গণমাধ্যম রয়েছে। যে কারণে কোন কিছুই লুকিয়ে থাকতে পারে না। দেশের অসামঞ্জস্যগুলো জনগণের সামনে তুলে আনে গণমাধ্যম। এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ। সংসদীয় গণতন্ত্রের কারণে এই রাষ্ট্রটি এখনো ইউনাইটেড রয়েছে। যেখানে সাধারণ নির্বাচনে জনগনের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। লোকসভায় ৩৫টি দলের প্রতিনিধি রয়েছে। সেখানে গণমাধ্যমও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করেন রিপাবলিকান অব কোরিয়ার প্রতিনিধি। তিনি বলেন, আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণতন্ত্রকে পৌঁছে দিয়েছি। সকলেই এখন গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সংস্কৃতির বিকাশের কারণে। শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্য কাদের মাস্তান বলেন, গণতন্ত্রের জন্য শিক্ষার বিকাশ ও দারিদ্র নিরসন জরুরী। শ্রীলংকা সেই কাজটি করছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে শ্রীলঙ্কা ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। সকল ধর্ম ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে এই উন্নয়ন কাজ চলছে। আইপিইউ সদস্য দেশগুলোর জন্য এবিষয়ে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় স্কুল থেকে গণতন্ত্রের শিক্ষা শুরু হয়। জাম্বিয়া প্রতিনিধি বলেন, আমাদের সংসদে উন্মুক্ত একটি সেশনের সুযোগ রয়েছে। যেখানে সকলেই কথা বলতে পারেন। সংসদীয় কার্যক্রম জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে গণমাধ্যম। আইপিইউতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি তার বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিনিধি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিকাশে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে চায় আইপিইউ
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারবে না কোনো সদস্য রাষ্ট্র। বরং মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো কৌশলে এই এটা প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে দু’দিনের আলোচনায় ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এছাড়া জরুরি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়েও গতকাল সোমবার আলোচনা হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়। আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী উপস্থিতিতে এই অধিবেশনে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একই সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং শান্তি ও বিশ্ব নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা চলেছে। এরপর আলোচনা হয়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কৌশল নিয়ে। তবে কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বুধবার এসকল বিষয়ে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করা হবে। এসকল বিষয়ে আইপিইউ সেক্রেটারি জেনারেল মাটিন চুংগং বলেন, শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। সদস্য দেশগুলো আলোচনা করছে। আশা করি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমরা এমন কিছু করবো না, যাতে আন্তর্জাতিক কোনো আইন লঙ্ঘিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকেই খসড়াটি প্রণয়ন করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আইপিইউ’র অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত আইপিইউ সেক্রেটারি বলেন, আমরা সংসদগুলোকে শক্তিশালী করতে চাই। তারা এ সংক্রান্ত আইন পাস করতে পারে। জনগণকে সচেতন করতে পারে। এ বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর সংসদের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সম্মেলন থেকে সংসদগুলো সেই উদ্যোগ নিবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ কার্যক্রমে কোনো দেশই যেন আর্থিক বা জনবল কোনো কিছুতেই সহায়তা না পায় সেগুলো বন্ধ করার বিষয়ে নিজ নিজ দেশের সংসদের কি ভূমিকা হতে পারে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, নিজ দেশে নিরাপত্তাসহ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। আমরা বর্তমানে বৈশিকভাবে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক পাচারসহ নানা সমস্যায় ভুগছি। এসবের থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইপিইউভুক্ত দেশগুলোকে এক হয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এন ইভানস বলেন, যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। হাউস ও কমন্সের বাইরে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল তা শুধু যুক্তরাজ্য নয়, সারাবিশ্বের গণতন্ত্রের উপর হামলা। তাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি বলেন, সামাজিক বৈষম্য এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একে অপরের পরিপূরক। তাই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চিরতরে নির্মূল করতে হলে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সেই বিষয়টি আইপিইউ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছে।
রাশিয়ায় আইপিইউ সম্মেলনে ইউক্রেনের আপত্তি
ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৭তম সম্মেলন রাশিয়ায় অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের এমপি বি. টারজোক সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। দেশটি চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আইপিইউ যেসব বিষয় ধারণ করে তা রাশিয়ার মধ্যে নেই। তাই ওই দেশে আইপিইউ সম্মেলন যাতে না হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। বি. টারজোক বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে লুটতরাজ চালিয়েছে। আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। রাশিয়া যদি জাতিসংঘের নিয়মগুলো মেনে চলে তাহলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিনি বলেন, আইপিইউ ও জাতিসংঘ মিলে আমরা শান্তি রক্ষা করে চলতে চাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করতে চাই আর যেন একটিও মৃত্যু না ঘটে। কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।