মিয়ানমার সীমান্তে সহিংসতার ঘটনা তদন্তে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করবে দেশটি। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির নেতৃত্বে এ কমিটির সদস্য থাকবেন ২৭ জন। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে হামলার তদন্ত করবে এ কমিটি। সেখানে কিভাবে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়, সে লক্ষ্যে সুপারিশও করবে এ কমিটি। শুক্রবার মিয়ানমার টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ মনে করছে মিয়ানমার সীমান্ত খুলে দিলে সেদেশের সরকারী বাহিনী নির্যাতন অব্যাহত রাখবে। এছাড়া বাংলাদেশের কাছে পুশব্যাকের হিসাব থাকলেও অনুপ্রবেশের কোন হিসাব নেই। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিদেশী কূটনীতিকদের চাপে রাখাইন রাজ্যের সহিংস ঘটনার তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিজিপির ওপর হামলার পর যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা যথাযথ তদন্তের জন্য ২৭ সদস্যের একটি জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করবে মিয়ানমার সরকার। এ কমিটির প্রধান হবেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি। কমিটির সদস্যরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করবেন। তারপর এ বিষয়ে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবেন।
মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিলর অফিসের সদস্য উ জো হেতে মিয়ানমার টাইমসকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয় পর্যায়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ টাস্কফোর্স কমিটি সীমান্ত এলাকার সহিংস ঘটনার তদন্ত করবে। এ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। মিয়ানমার টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তে বিজিপি সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় উত্তর রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি নির্দেশ দিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে আইন ও বিধি-নিষেধ মেনেই অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সীমান্তে বিজিপি সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৯-১৪ নবেম্বর ২৩৪ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া ১৪-২৩ নবেম্বর পর্যন্ত আরও ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৬৯ সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী হত্যার শিকার হয়েছে।
মিয়ানমার সীমান্তে সামরিক বাহিনীর অভিযানের পর হাজার হাজার রোহিঙ্গা বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেরই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসতভিটা ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এদের মধ্যে অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। আবার অনেকেই বাংলাদেশে আসার জন্য সীমান্তে অপেক্ষা করছেন।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সেদেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনা অভিযান। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২ শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এদিকে দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এ প্রেক্ষাপটে সীমান্তে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এ বিষয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে মিয়ানমার সীমান্তের পরিস্থিতি অবহিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সমর্থন চেয়েছে বাংলাদেশ। এ সমস্যা দ্রুত সমাধানে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দেয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে সরকার। এছাড়া বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। এদিকে মিয়ানমারের শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসংঘ, এইচআরডব্লিউসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। তিন দশক ধরে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এ শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এদিকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে জনকণ্ঠের রিপোর্টার হাসান নাসির ও এইচএম এরশাদ জানিয়েছেন, পুশব্যাকের হিসাব থাকলেও কত রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তার হিসাব নেই। দালালদের সহযোগিতায় দুর্গম পথে তারা ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। এমতাবস্থায় সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বিজিবি। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতা আনয়নের পরিকল্পনাও নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পল্লীতে হামলা কমে এলেও আতঙ্ক এখনও কাটেনি। শত শত রোহিঙ্গা বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো অবস্থায় রয়েছে সুযোগ পেলে বাংলাদেশে পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায়। জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিতে রাজি নয় এ কারণে যে, এতে মিয়ানমার সরকারের বাহিনী নির্যাতন অব্যাহত রাখতে উৎসাহী হবে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে শুক্রবার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বিক্ষোভ হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সি ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ ও নিন্দার প্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকার আবারও বলেছে যে, পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিয়োজিত লবিস্টরা।
ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রধান জন মেকিসেকের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, রাখাইন প্রদেশে অব্যাহত নির্যাতন, হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা সমুদ্র পথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। এ অবস্থায় সীমান্ত খুলে দেয়ার জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি অনুরোধ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য জটিলতার বিষয় হলো সীমান্ত খুলে দিয়ে অবাধ ও অনুপ্রবেশের সুযোগ দিলে মিয়ানমার সরকারের বাহিনীকে আরও নির্যাতনে উৎসাহিত করা হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার উদ্বেগের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র তিন কিয়াউ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নির্যাতনের যে তথ্য প্রচারিত হয়েছে তা সঠিক নয়। যেভাবে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তাকে ফেব্রিকেটেড নিউজ হিসেবে দাবি করে তিনি বলেন, তাদের সরকার এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছে।
মোঃ আয়াজ নামের নির্যাতিত এক রোহিঙ্গার উদ্ধৃতি দিয়ে এএফপি জানায়, তার গ্রামে আগুন দিয়ে শতাধিক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জান্নাতুল নাঈমকে। তার দুই বছরের পুত্র সন্তানকেও রাইফেলের বাটের আঘাতে আহত করা হয়েছে। শুক্রবার বিক্ষোভ হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব সমাবেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নাগরিক স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানানো হয়। মালয়েশিয়া সরকার সেদেশে অবস্থানরত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও তাদের জন্য প্রার্থনায় যোগ দেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ধাতুক সেরি নাবির। ইন্দোনেশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানানো হয়, আসিয়ানভুক্ত দেশ ও বিশ্বের মানবতাবাদী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধাÑ এ দুটোরই সমালোচনা করে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের প্রতি দুই দেশের আচরণই নিষ্ঠুর। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক শম্পা প্যাটেল বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা, যারা নাফ নদী বা ভূমিতে আত্মগোপন করে আছে তারা খাবার, পানি ও জরুরী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিভিন্ন পথে যারা বাংলাদেশে ঢুকে গেছে তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন শুক্রবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট পরিদর্শন করেন। টেকনাফে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুয়ায়ী বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যৌথ স্বাক্ষরে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে সীমান্ত এলাকায় শান্তি বজায় রাখার আলাপ চলছে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। উভয়পাড়ে শান্তি বজায় রাখতে ওই চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন চলছে। ফলে অনুপ্রবেশের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে যেভাবে অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে- তা সঠিক না। মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শনের জন্য বিজিবি মহাপরিচালক বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে আসেন। ওইদিন বিকেলে ঘুমধুম ও শুক্রবার সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপসহ একাধিক সীমান্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে সীমান্তে নিয়োজিত বিজিবির সদস্যদের কঠোরভাবে দায়িত্বপালনপূর্বক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। বিজিবি সদস্যদের মিয়ানমার বিজিপির সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে দায়িত্ব পালনেরও নির্দেশ প্রদান করেন বিজিবির ডিজি ।
বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক বলেন, সীমান্তের ৬৩ কিলোমিটার জল সীমান্তসহ ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের সবগুলো এলাকা সিলগালা করে বন্ধ করা সম্ভব নয়। টহল জোরদার এলাকা বাদে অন্য যে পয়েন্ট দিয়ে সুযোগ পায় সেখান দিয়েই যে বিপদাপন্ন রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেছে তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। অবস্থার প্রেক্ষিতে যেসব এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে- সেসব এলাকা চিহ্নিত করে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হলে লোকাল কমিউনিটি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন।
মিয়ানমারে বিজিপি চৌকিতে হামলা ঘটনায় সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছে বলে দেশটির সরকার যে দাবি করেছে সে প্রসঙ্গে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এখানে দেশী-বিদেশী কোন সন্ত্রাসী অবস্থান করে অপতৎপরতা চালানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা কারো শত্রু নই, সীমান্তের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক রয়েছে। হয়ত তাদের বিশ্বাসে ঘাটতি রয়েছে, তাই এমন চিন্তা তারা করছেন। আমরা ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা গুলিবিদ্ধ দুই অপরাধীকে ধরে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের সীমান্তরক্ষীদের (বিজিপি) কাছে হস্তান্তর করেছি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিজিবি চট্টগ্রাম রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান, কক্সবাজার সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার কর্নেল এমএম আনিসুর রহমান, টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ, টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শফিউল আলম প্রমুখ।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, দিনের বেলায় সীমান্তে বিজিবির কড়া পাহারা থাকায় রাতের অন্ধকারকে অনুপ্রবেশের জন্য নিরাপদ সময় বলে বেছে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। অনুপ্রবেশকারীদের স্বদেশে ফিরিয়ে দিলেও তারা ওপারে বেড়িবাঁধে, ঝোপ-জঙ্গলে নতুবা সেখানকার রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরে আশ্রয় নিয়ে ফের রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। টেকনাফ ও উখিয়ার অরক্ষিত ১৩৪ কিলোমিটার সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে বিজিবি সদস্যরা। এক পয়েন্ট দিয়ে ফেরত পাঠালে অপর পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। ওপারের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া সূত্রমতে, গোটা আরাকানজুড়ে সেনা বাহিনীর অভিযান নেই। শুধুমাত্র মংডুর উত্তরে বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্রোহী দমনকল্পে দেশটির সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে। ওইসব পাড়া থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গা পরিবারগুলো ধেয়ে আসতে চাইছে বাংলাদেশে। শুক্রবার ভোরেও নাফ নদীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই ৪টি নৌকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। বিজিবি সদস্যরা তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিয়েছে। এর আগে যারা বাংলাদেশ সীমান্তের জিরোলাইনে এসেছে, ওসব রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা, খাবারসহ মানবিক সহায়তা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে বিজিবি ও পুলিশ। শুক্রবার সকালে রেজু আমতলী বিজিবি সদস্যরা তিনজন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে ফেরত দিয়েছে মিয়ানমারে। এদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ও এক শিশু রয়েছে।
সীমান্ত এলাকার কতিপয় দালাল ও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উস্কানিতে অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গ। টেকনাফের নয়াপাড়া ও কুতুপালং ক্যাম্পে সরকারী তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। উভয় ক্যাম্পের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এছাড়াও তিন দশক ধরে বসবাসকারী ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ। এর ওপর নতুন করে রোহিঙ্গাদের প্রবেশে এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে স্থানীয়রা। নতুন করে শরণার্থীর আগমনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সচেতন মহলও। বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দ্রুত ফেরত পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, সন্ত্রাস দমনের নামে মিয়ানমারে মংডুর বিভিন্ন গ্রামে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হামলা, ধরপাকড় ও নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারে চলছে মানবতার চরম লঙ্ঘন। জাতিসংঘ উদ্বেগ ব্যক্ত করলেও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনও কোন উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার সরকার। ৯ অক্টোবর মংডুর ৩টি পুলিশ পোস্টে সন্ত্রাসী হামলা ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশের নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতনের পর রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ইতোমধ্যে বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেও পড়েছে। ইতোপূর্বে সহিংসতার শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের জন্য নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এক প্রকারে বোঝা হয়ে আছে। এদের অনেকে মিথ্যা পরিচয়ে নাগরিক সনদও হাতিয়ে নিয়েছে। জঙ্গীসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়েছে। সীমান্তে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ কড়াকড়ি না করলে অনুপ্রবেশকারীদের চাপ আরও বেড়ে যেত।
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই করে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ ব্যাপারে মিয়ানমার নির্বিকার। দুই বছর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে মিয়ানমার দুই মাসের ভেতর ২ হাজার ৪’শ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা দিয়েও তা রাখেনি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সীমান্ত খুলে দেয়ার জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে নমনীয় হতে বললেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করায় স্থানীয় অধিবাসীরা রোহিঙ্গাদের বাড়তি বোঝা থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। কেবল মিয়ানমারই রোহিঙ্গা সমস্যার কার্যকর ও যথাযথ সমাধান করতে পারে মন্তব্য করে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবজার জেলা সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী (খোকা) জনকণ্ঠকে বলেন, অনুপ্রবেশ বা যুগ যুগ ধরে আশ্রয় নয়, মিয়ানমারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অবস্থান করা একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নাগরিক অধিকার পাবে এ প্রত্যাশা করছেন সকলে। তাহলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত ওই জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের মাতৃভূমিতে ফেরার সুযোগ তৈরি হবে।
আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা দেশটির নাগরিকত্বের স্বীকৃতি সমস্যায় ভুগছে। এ নিয়ে ১৯৭৭ সালে রোহিঙ্গা রাখাইনদের মধ্যে তৃণমূল উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বিএনপি সরকারের আমলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ২০০১ সাল থেকে মুসলিম বৌদ্ধ জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। ২০১২ সালেও রাখাইন-রোহিঙ্গা জাতিগত দাঙ্গা চলে। সর্বশেষ ১০ অক্টোবর থেকে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যার কারণে আরাকান রাজ্যে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। সেনা সদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে টেকনাফের শাহ্পরীর দ্বীপ হতে উখিয়ার বালুখালী পর্যন্ত ২০ পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
সুত্র :: জনকন্ঠ