এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ::
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাটি প্রতিবার ঘুরেফিরে বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সামনে এনে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কয়েক বছর পর পর রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়ে। একজন প্রবীণ রোহিঙ্গা নেতা বলেন, প্রায় ৬৮ বছর আগে আরাকান অঞ্চলকে পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন রোহিঙ্গাদের কিছু স্থানীয় নেতা। তখন থেকে মিয়ানমারের রাখাইন গোষ্ঠীর কাছে রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবে সন্দেহের পাত্রে পরিণত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার দৃঢ় নীতিতে অটল থাকে। কিন্তু সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকতে উগ্র ইসলামী ধর্মীয় গোষ্ঠীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তখন থেকে বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতার পাশাপাশি আরএসওসহ রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে। জামায়াত-বিএনপির কতিপয় নেতার বদৌলতে আরএসওর সশস্ত্র ক্যাডাররা কক্সবাজার ও পার্বত্য বান্দরবানে অবাধে চলাফেরা এবং বসবাস করার সুযোগ পায়।
সূত্র জানায়, ১৯৪৮ সালে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকায় পালিয়ে এসে বসতি গেড়েছে। স্থানীয় লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশের মুসলমান হিসেবে এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। এটা যে ভবিষ্যতে অন্যের বোঝা আমাদের মাথায় আসতে পারেÑ তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি তখন। তৎকালীন বিএনপি সরকারের মদদ পেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো। তারা হঠাৎ করে আক্রমণ চালায় মিয়ানমারের তুমব্রু সীমান্তরক্ষী লুনটিন ঘাঁটিতে। পাকিস্তানীদের সঙ্গে আরাকান অঞ্চলকে যুক্ত করার চেষ্টার পর থেকে এমনিতে সেখানে বসবাসকারী বিশাল গোষ্ঠী রাখাইন জাতি ও তাদের শাসকদের রোহিঙ্গা জাতির প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধে। তদুপরি সীমান্তরক্ষীর ঘাঁটিতে সশস্ত্র হামলার ঘটনায় আরও বেশি সন্দেহ জাগে রোহিঙ্গা পরিবার থেকে যোগ দেয়া আরএসও ক্যাডারদের প্রতি। বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়ে সশস্ত্র আরএসও ক্যাডাররা হামলা চালিয়েছে দাবি করে তাদের হাজির করার জন্য দেশটিতে বসবাসকারী স্বজনদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। ওই সময় (১৯৭৮ সালে) প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। আরএসও ক্যাডারদের জন্য আরাকানে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান চালালে ১৯৯১ সালের শেষের দিকে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের আমলে আবারও প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ওই সব রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার শরণার্থীর এখনও প্রত্যাবাসন হয়নি। ১৯৯৪ সালে ফের দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বস্তি তৈরি করে বসবাস করে চলছে। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের মংডু কাউয়ারবিলে সীমান্ত বাহিনীর (বিজিপি) তিনটি ক্যাম্পে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা হামলা চালায়। এতে মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর ৯ সদস্য নিহত হয়েছে দাবি করে কম্বিং অপারেশন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেনা ও পুলিশের অত্যাচার সইতে না পেরে বাংলাদেশে ধেয়ে আসতে চেষ্টা চালায় বহু রোহিঙ্গা পরিবার। বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি-কোস্টগার্ড নজরদারি বৃদ্ধি করলেও বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নতুন ঘটনা নয়। ১৯৭৮, ৯১ ও ৯৪ সালে তিন দফায় ধেয়ে আসা প্রায় ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে বসবাস করছে। সীমান্তে কড়াকড়ির মধ্যেও মিয়ানমারের কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবার বিচ্ছিন্নভাবে এদেশে অনুপ্রবেশ করছে। ওপারে সীমান্তের জিরো পয়েন্টেও অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা মানবেতর দিন যাপন করছে বলে জানা গেছে।
মিয়ানমারে সহিংস ঘটনার পর থেকে টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে কিছু কিছু রোহিঙ্গা ধেয়ে এসেছে। তবে আগের চেয়ে রোহিঙ্গার আগমন কমেছে বলে বস্তি ও শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। ক্যাম্পে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের মধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। গত ৯ অক্টোবরে মিয়ানমার বিজিপি ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলায় মিয়ানমার বিজিপি নিহত, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনার জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মংডুর উত্তরের ২২টি গ্রামে প্রায় দেড় মাস ধরে অত্যাচার নির্যাতন ও তা-ব চালিয়েছে। ধর্ষিতার ভাষ্য ॥ টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ধর্ষিতা রোহিঙ্গা তরুণী মোহছেনা বেগম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। মা, বাবা, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি বলতে মোহছেনার কেউ নেই। ৫ জনই নির্মমভাবে খুন হয়েছেন মিয়ানমার সেনার হাতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই বসতবাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সব হারিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সহোদর খাইর আহমদের সঙ্গে বাঁচার তাগিদে ‘আরাকান’ নামে পাঁচ মাস বয়সী শিশুপুত্রের ভবিষ্যত চিন্তা করে ২১ জনের সঙ্গে ২৭ নবেম্বর ভোরে টেকনাফ হোয়াইক্যং তুলাতলী পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডু টাউনশিপের আওতাধীন উত্তর জাম্বুনিয়ার বাসিন্দা ছৈয়দ আহমদের পুত্র আবদুস শুক্কুরের স্ত্রী মোহছেনা। মাসখানেক আগে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা তাদের গ্রামে অভিযান চালানোর সময় ৭ যুবতীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। মোহছেনা আরও জানান, পালাক্রমে ধর্ষণের ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সেনা সদস্যরা চলে যাওয়ার পর স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হয়েছে। সামান্য সুস্থ হলে জীবিত থাকা আত্মীয়দের সহযোগিতায় বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে। এখানে এসেও চিকিৎসা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশে এসে স্বস্তি বোধ করলেও তিনি খাবার, বাসস্থান, পোশাক, শীতবস্ত্রের সঙ্কটে রয়েছেন বলে জানান।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ডাঃ দুদু মিয়া জানান, মোহছেনা ছাড়াও মিয়ানমার সেনার হাতে ধর্ষণের শিকার আরও কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারী প্রথমে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও পরবর্তীতে শামলাপুর এবং কুতুপালং চলে গেছে। তাদের নাম-ঠিকানা সংরক্ষণ করা হয়নি। তিনি আরও জানান, এমনিতেই নিজেদের বেহাল অবস্থা। উপরন্তু নতুন করে আরও প্রায় ২ হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের চাপে বিশেষত খাবার সঙ্কটে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে লেদা বস্তির রোহিঙ্গারা। ধর্ষিতা মোহছেনাসহ আরও কিছু অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকে ডাঃ কবিরের আশ্রয়ে রয়েছে। ডাঃ কবির জানান, এরা তার আত্মীয় এমনকি পরিচিতও নয়। মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। মানুষের সাহায্য নিয়ে এদের জন্য কোন রকম খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।