[caption id="attachment_49613" align="alignleft" width="600"] মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এলিট ডিভিশন হিসেবে পরিচিত ৩৩ ও ৯৯ পদাতিক ডিভিশনের হত্যা আর অত্যাচারের মুখেই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। গত বছরের আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই ‘জাতিগত নিধন অভিযানের’ বিষয়ে রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
লেফটেন্যান্ট কেয়ি নিয়ান লিন
[/caption]মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এলিট ডিভিশন হিসেবে পরিচিত ৩৩ ও ৯৯ পদাতিক ডিভিশনের হত্যা আর অত্যাচারের মুখেই পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। গত বছরের আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই ‘জাতিগত নিধন অভিযানের’ বিষয়ে রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
রয়টার্সের এই প্রতিবেদনে উঠে আসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিধন অভিযানের অনেক কিছুই। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী, রাখাইনের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী, নিরাপত্তা রক্ষী ও সেনাসদস্যদের সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি তাদের ফেসবুক পোস্টও পর্যবেক্ষণ করে রয়টার্স।
বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার জবাবেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাল্টা ওই বর্বর অভিযান চালায়।
পদাতিক এ দুই ডিভিশনের হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ে সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে রয়টার্সের প্রতিবেদনে।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডার দেওয়া সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞায় দেশটির যে ৭ জেনারেলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে ডিভিশন দুটির প্রধানরাও রয়েছেন।
গত বছরের অাগস্টে আরসার হামলার আগে-পরে পদাতিক ডিভিশন দুটির সদস্যদের দেওয়া বিভিন্ন পোস্ট থেকে অভিযানের নানা অংশ এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের মনোভাবের ছবি ফুটে উঠেছে।
গত বছর অগাস্টের শুরুতেই আরও শতাধিক সৈন্যর সঙ্গে গোলযোগপূর্ণ রাখাইনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কেয়ি নিয়ান লিন (২৪)।
১০ অগাস্টে এই বিষয়ে জানিয়ে তার এক পোস্টে একজন মন্তব্য করেন, “তোমরা কি বাঙালিদের মাংস খেতে যাচ্ছ?” মিয়ানমারের অনেক নাগরিকই রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গালি’ বা আরও অবমাননাকর শব্দ ‘কালার’ বলে ডাকে। অপর এক মন্তব্যে সে আরও বলে, “কালারদের পিষে ফেলো, বন্ধু,।” যার উত্তরে লেফটেন্যান্ট লিন লিখেন,“অবশ্যই”।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে অবিহিত করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র একে ‘জাতিগত নিধন অভিযান’ বলে।
তবে, এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। লিনও বলছেন, ‘বাঙালি সন্ত্রাসীদের’ হামলার শিকার হওয়ার পরই সৈন্যরা পাল্টা অভিযানে নামে।
অভিযানে কোনো হত্যাযজ্ঞ বা অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলেও রয়টার্সকে জানান এ লেফটেন্যান্ট।
জাতিগত সহিংসতার কারণে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি আগে থেকেই উত্তপ্ত ছিল। ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দেওয়ার জন্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের দায়ী করা হচ্ছিলো।
২০১৭ সালের অগাস্টের শুরুতে রাখাইনে মোতায়েন করা হয় ৩৩ ও ৯৯ পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের। ফেসবুকে দেওয়া সৈন্যদের তখনকার ছবিগুলোতে বাহিনীর সদস্যদের রাখাইনের সিটুই বিমানবন্দরে অবতরণ করতে ও নৌকাবোঝাই হতে দেখা গেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অং সান সুচির সরকার তখন উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে ‘শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতেই এ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছিল।
২০১৭-র অগাস্টে ফেসবুকে দেওয়া বাহিনী সদস্যদের বিভিন্ন ছবিতে যেসব এয়ারক্রাফট ও নৌকা দেখা গেছে তাতে মিয়ানমারের বিমান, নৌ ও সামরিকবাহিনীর যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন মিলিটারি কমান্ড স্ট্রাকচার বিষয়ক তিন বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আবুল বাশার নামে একজন রোহিঙ্গা জানান, মধ্য অগাস্টে ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের এক কমান্ডার পিন গ্রামের অধিবাসীদের হুমকি দিয়ে বলেন- “এখানে আসার আগে আমরা কাচিনের যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম। আমরা সেখানে ভয়াবহ খারাপ আচরণ করেছি, তারা ছিল নাগরিক, তোমরা তাও না, এখন ভাবো কি হবে।”
২৫ অগাস্ট আরসা ডজনের ওপর নিরাপত্তা চৌকি ও রাখাইনের সেনাঘাঁটিতে হামলা চালালে তাৎক্ষণিকভাবে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সঙ্গে নিয়ে পদাতিক ডিভিশন দুটো পাল্টা অভিযান শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা পরে রয়টার্সকেও জানিয়েছেন পুলিশ ও বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা।
“আমাদের তাড়াতাড়ি রাখাইনের সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় পাঠানো হোক। আমি যুদ্ধ করতে চাই। প্রতিশোধ নিতে দেশ আমাকে যেভাবে আহ্বান করছে, তা অগ্রাহ্য করতে পারছি না,” আরসার হামলার পর ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেছিলেন ৯৯ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট সাই সিট থোয়াই।
২৬ বছর বয়সী ওই লেফটেন্যান্টের ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল।
“আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, কালাররা সব চলে গিয়েছিল,” কোনো ধরনের হত্যাযজ্ঞ কিংবা অগ্নিসংযোগে তিনি নিজে অংশ নেননি বলে দাবি করেন থোয়াই।
অভিযানের প্রত্যেকদিন যে একটার পর একটা গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হতো তার সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা।
প্রতিটি দলে ৫ থেকে ৭জন পুলিশ সদস্য ও ২০ জন সেনাসদস্য থাকতো। পুলিশ ঘরগুলো ঘিরে রাখতো, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে এসে আগুন ধরিয়ে দিতো।
উত্তর মংডুর মিন গেয়ি গ্রামে সৈন্যরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও।
৯৯ পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যরা যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল তার পক্ষে সাক্ষ্য মিলেছে গ্রামটিতে অবস্থান করা রাখাইন চেয়ারম্যানের কাছ থেকেও।
তুলাতুলি গ্রামের তিন নারী, যারা এখন বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন, ৯৯ পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যদের হাতে নিজেদের ধর্ষিত হওয়ার মর্মস্পর্শী বর্ণণা দিয়েছেন রয়টার্সকে। বেগম নামে একজন জানিয়েছেন, তাকে ধর্ষণের আগে তার ছোটবোনকে জবাই করেছিল মিয়ানমারের এক সৈন্য।
“কালাররা শান্ত হয়ে গেছে। তাদের গ্রামগুলো পুড়ে গেছে,” ফেইসবুকে ৫ সেপ্টেম্বর দেওয়া অপর এক পোস্টে বলেন লেফটেন্যান্ট সাই সিট থোয়াই অং।
রোহিঙ্গারাই নিজেদের বাড়ি পুড়িয়ে সেনাবাহিনীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে বলেও দাবি এ সেনা কর্মকর্তার।
অভিযানের পর পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার ছবিও মিলেছে ফেসবুকে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযান সারা বিশ্বেই চরম সমালোচিত হয়েছে। অভিযানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। সর্বশেষ ২৫ জুন মিয়ানমারের ৭ জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
যদিও এসব নিষেধাজ্ঞার কোনোটিই সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মিন অং হ্লাইংকে স্পর্শ করেনি। ২০১১ সালে তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের পদাতিক ডিভিশনগুলোর ওপর কার নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি, এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির সামরিক ইতিহাসবিদ ও ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সাবেক কর্নেল থং ওয়াই ও-র উত্তর, “জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অঙ হ্লাইংয়ের।”
রাখাইনের অভিযান নিয়ে কিছু বলতে রাজি না হলেও সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা জানান একমাত্র সেনাপ্রধানই বড় বড় সামরিক অভিযানে পদাতিক ডিভিশন মোতায়েন করতে পারেন।
“চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শীর্ষ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের কাছ থেকেই আসে,” বলেন থং।