
উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিলেও হাল ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে হতাশা থাকলেও চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে আলোচনা চালাতে চায় দলটি। কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রভাবশালী এই দেশটিকে প্রভাবিত করার প্রত্যাশাও করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের উপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। এরপর দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও রাখাইনে ‘সেইফ জোন (নিরাপদ অঞ্চল)’ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে ঢাকা।
এরই মধ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করে এসেছে আওয়ামী লীগের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। ঢাকা ছাড়ার আগে এই সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন প্রতিনিধিদলটির সদস্যরা। একই কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
চীন সফর শেষে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এই সফরকে ‘সফল’ বলছেন। প্রতিনিধিদলের সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া চীন সফরের বিষয়ে জানান, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার লি জোন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে চীন মিয়ানমারকে চাপ দেবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও নিরাপত্তা পরিষদে চীন মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে চীনের পক্ষ নেয় চীন।
দলের একটি সূত্র বলছে, বর্তমান সরকারের আমলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়নের চেষ্টা চলছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর তার বড় নমুনা। অস্ত্রক্রয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে রোহিঙ্গা প্রস্তাবে চীন বিরোধিতা করেনি। সবমিলিয়ে মানবিক বিবেচনায় নিরাপত্তা পরিষদের গত শুক্রবারের উন্মুক্ত বিতর্কে চীন মিয়ানমারের বিপক্ষে থাকবে বলে প্রত্যাশা ছিল দলটির, যদিও সেটা হয়নি।
শুক্রবারের বৈঠকে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতায় নিরাপত্তা পরিষদে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আওয়ামী লীগ যে ক্ষুব্ধ ও হতাশ তা ওবায়দুল কাদেরই স্পষ্ট করেছেন। শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে চীনের কড়া সমালোচনা করে সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী বলেন, ‘একদিকে মানবিক সহযোগিতা করবেন, আরেকদিকে হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করবেন- এটা দ্বিচারিতা। আমরা এটি আশা করি না।’
তবে এই ইস্যুতে চীনের অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চায় আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘কোনো দেশকে তো আমরা ডিকটেট (হুকুম) করতে পারি না। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব একটি পররাষ্ট্রনীতি থাকে। চীন তো তাদের অবস্থানেই থাকবে। তাদের কূটনৈতিক, ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে। আমরা তো তাদের বলতে পারি না যে, ওটা করবা কিংবা ভেটো দিবা না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে তো চীনের বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়ার কিছু নেই। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। এখানে বাংলাদেশ ভিকটিম মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কারণে। এখন মানবিকতা লংঘনের বিষয়ে তারা ভেটো দিবে, নাকি না দিবে তা তো তাদের নিজস্ব বিষয়। এখানে আমাদের পক্ষে বলার কিছু নেই। সে হিসেবে চীন ওদের পয়েন্টে ঠিক আছে, রাশিয়াও তার পয়েন্টে ঠিক আছে।’
এই সফরকে ‘সফল’ দাবি করে আওয়ামী লীগের এই নেত্রী বলেন, ‘এখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে কেউ নেই। এখন রোহিঙ্গাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কে থাকবে না থাকবে তা পরের বিষয়। কারণ এখানে ভূ-রাজনৈতিক বিষয় আছে। কিন্তু আমরা খুব ক্রিটিক্যাল পজিশনে আছি। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি, আবার এই ভার বহনের ক্ষমতা আমাদের নেই। এই মানবিক দিকে চীন আমাদের পাশে থাকবে বলে কথা দিয়েছে।’
শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘মানবাধিকারের বিষয়টি আমরা চীনের সামনে তুলি। তারা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরাতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে মিয়ানমারকে চাপ দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।’
চীনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সবারই একটা পলিসি আছে, সেটা তারা রাতারাতি চেঞ্জ (পরিবর্তন) করবে না। চীনের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে, আশা করি আপনারা এর সুফল দেখতে পাবেন।’
‘আর এটা তো এমন না যে- গেলাম, আলোচনা করলাম আর সঙ্গে সঙ্গে চেঞ্জ হয়ে গেল। কূটনৈতিক প্রসেস আমরা চালু রাখবো। ধীরে ধীরে এর সুফল আসবে, রাতারাতি না’ যোগ করেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক এই সম্পাদক।
এ ইস্যুতে সরকার ‘কূটনৈতিকভাবে সফল’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক আলোচনা সবার সঙ্গে চলতে থাকবে। সবাই শুরুতে রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে ছিল, এখন সবাই তাদের সাথে আছে। এটাই আমাদের কূটনৈতিক সফলতা।’
এই ইস্যুতে চীনের অবস্থান আরো ইতিবাচক হবে প্রত্যাশা করে চীনে সফর করা প্রতিনিধিদলটির প্রধান ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘আমরা চীনকে প্রকৃত অবস্থা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারা এখন ত্রাণ পাঠাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক সফলতা সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্যমান হয় না। ধীরে ধীরে এর প্রভাব বুঝা যাবে।’
একই কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘চীনের প্রথম যে অবস্থান ছিল, এখন সেই অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে; আরো আসবে। এটি আমাদের কূটনৈতিক সফলতা।’
তিনি বলেন, ‘এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো আমাদের পক্ষেই আছে। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে, আশা করছি সবাই আমাদের পক্ষেই থাকবে।’
পাঠকের মতামত