
মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হওয়া সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য বাংলাদেশে ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শুক্রবার ২ হাজার ২০০ টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জাহাজটি যাত্রা করে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এ ত্রাণসামগ্রী পাবেন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিজ দেশে মানবেতর জীবনযাপন করা রোহিঙ্গাদের জন্যও ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে।
২০ জন চিকিৎসকসহ ২৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে যাত্রা করেছে ‘নটিক্যাল আলিয়া’। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে জাহাজটির গতি ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাহাজটির সেকেন্ড অফিসার জাস্টিন সাভারি নাথান।
তিনি জানান, আন্দামান সাগরে পৌঁছানোর পর জাহাজের গতি আরও বাড়তে পারে।
রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশিয়ার ত্রাণবাহী জাহাজকে বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলে নোঙ্গরের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শনিবার মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার রাতে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি আনিফাহ আমান। ওই বৈঠকের পরই এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুমতির কথা জানানো হয়।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে টেকনাফ উপকূলে মানবিক ত্রাণবাহী এ জাহাজ নোঙ্গরের অনুমতির জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন এবং সহিংসতার ভয়ঙ্কর সব সাক্ষ্য প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া এক নারী জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তাকে যখন ধর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে এসে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল। তখন হামলাকারীদের একজন তার মেয়েকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দফতর বলেছে, রাখাইনে যা ঘটছে তা সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর দায়িত্ব মিয়ানমারকে নিতে হবে।
এ ধরনের আরও ভয়ঙ্কর সব ঘটনার সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের কর্মকর্তারা। তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসা দুই শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমের সঙ্গে কথা বলেছেন।
রিপোর্টে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সাক্ষ্যদানকারী রোহিঙ্গারা সেখানে হত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অনেক সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন।
অর্ধেকের বেশি নারী বলেছেন, তারা ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

সাক্ষ্যদানকারী রোহিঙ্গারা আরও জানিয়েছেন, সেখানে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের সবাইকে তাদের বাড়িতে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্কুল, মসজিদ, ক্ষেতের ফসল এবং গবাদি পশু।
মিয়ানমার সরকার অবশ্য বরাবরই এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে। দেশটির দাবি, ‘সন্ত্রাসী’দের খুঁজতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। সংঘাতকবলিত এলাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চলমান জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ সীমান্তে। মাথায় একটাই চিন্তা; কিভাবে নরককুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা যায়? সেই নরক থেকে বেরিয়ে আসা একজন লালু বেগম। তার ভাষায়, ‘১০ বছরের অধিক বয়সের কোনো বালককে পেলেই তারা তাদের হত্যা করে। পুরুষদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই নারী জানান, তাদের সম্প্রদায়ের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হচ্ছে।
লালু বেগম ‘সেনাবাহিনী যখন আসে তখন আমরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমি জানি না আমার স্বামী জীবিত আছেন নাকি তিনি মৃত।’
বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় অবস্থান করছেন লালু বেগম। তিনি সিএনএনকে জানান, তার গ্রামের বহু নারী সরকারি সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
লালু বেগম বলেন, ‘তারা যখন কোনও সুন্দর নারী দেখে তখন তারা তাদের কাছে পানি চায়। এরপর তারা ঘরে ঢুকে তাদের ধর্ষণ করে।’
রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাস। জাতিসংঘের ভাষায় এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। এমনকি বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে সেখান বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত প্রদান করে না মিয়ানমার সরকার।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে রাজি নয়। তারা এ সম্প্রদায়ের মানুষদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বহু মানুষই মিয়ানমারে তাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা জন ম্যাককেসিক বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর ‘যৌথ নিপীড়ন’ চালাচ্ছে। সূত্র: দ্য স্টার, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, সিএনএন।

পাঠকের মতামত