প্রকাশিত: ০১/০৬/২০১৭ ১০:০১ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:১৫ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে নগরীতে ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তখনও ইফতারের ঘণ্টা দুয়েক বাকি। আসরের আজান ভেসে আসছে পাশের কোনো মসজিদের মাইক থেকে। ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের মূল ফটকের বাইরে লোকজনের ভিড় বাড়ছে। ফটকের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে খুলে যায় প্রধান ফটক। সারি বেঁধে বিহারে ঢুকতে থাকেন শত শত মানুষ। ভেতরে বড়সড় একটা টেবিলে থরে থরে সাজানো ইফতারির প্যাকেট। সামনে রোজাদার দুস্থ মুসলিমদের দীর্ঘ সারি। সুশৃঙ্খল লাইনের এক পাশে নারী আরেক পাশে পুরুষ। কোনো হট্টগোল ছাড়াই নিভ্রতি থের ভিক্ষুর কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মানুষগুলো একে একে এগিয়ে যাচ্ছেন, আর মহাবিহারের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের হাত থেকে ইফতারির

প্যাকেট নিচ্ছেন। সবাই ইফতার নিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে যাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সবুজবাগের অতীশ দীপঙ্কর সড়কের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। আশপাশের অসহায় ও দুস্থ রোজাদারদের মধ্যে এভাবে ১৬ বছর ধরে ইফতার বিতরণ করছে বিহার কর্তৃপক্ষ। এখানে পাঁচ বছর ধরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নড়াইলের আজাদ মুন্সি বলেন, ‘ধর্ম নয়, এখানে মানুষই বড়।’

ইফতার তদারকির কাজে নিয়োজিত নিভ্রতি থের ভিক্ষু বলেন, ‘ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ এই ইফতার বিতরণ। বছর পাঁচেক আগেও ইফতার নিতে আসা মানুষের সংখ্যা একশ’-দেড়শ’ ছিল। এখন সে সংখ্যা প্রায় ছয়শ’ ছাড়িয়ে গেছে। লোক বাড়লে প্যাকেটের পরিমাণ বাড়ানো হয়। অসহায় মানুষকে অন্ন দেওয়াটা খুব আনন্দের।’

এখানে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ইফতারি দেওয়া হয়। ইফতারে থাকে চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলা ভুনা, শাহি জিলাপি ও মুড়ি। রাহেলা বেগম এসেছেন তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে। সবার হাতে ইফতারির প্যাকেট। তিনি বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে প্রতিদিন ইফতার নিচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, এক আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। ভেদাভেদ ভুলে এখানে যেভাবে ইফতার দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমি অনেক খুশি।’

ইফতারি নিতে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ মফিজুর রহমান। কাছে যেতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বাবা আমরা গরিব মানুষ, আমাগোরে ইফতারি দেয়। দিন শেষে এটা অনেক আনন্দের। খুব ভালো লাগে। আল্লাহ ওদের মঙ্গল করুক।’

মন্দিরের সামনের হারুন হোটেল পুরো ইফতার বানানোর কাজ তদারকি করে। প্রতিদিন সকালে মন্দির থেকে হারুন হোটেলের ম্যানেজার কৃষ্ণপদ সাহাকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের পরই মন্দিরের ভেতরে অবস্থিত রান্নাঘরে ইফতারি তৈরি হয়। প্রতি প্যাকেটে খরচ হয় ৫০ টাকা। কেউ কেউ ইফতারের পরও আসেন ইফতার নিতে, তখনও তারা খালি হাতে ফেরেন না।

বিহার থেকে ইফতার হাতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন রিকশাচালক আলিমুজ্জামান। তার চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে ইফতার নিতে কেমন লাগছে প্রশ্ন করতেই আবেগাপ্লুুত হয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধরা দিচ্ছে বলে ইফতার নেওয়া যাবে না_ আমরা এ নীতি মানি না। গরিবের জন্য এসব নিয়ম কাজে আসে না।’

মন্দিরের পাশেই কাপড়ের ব্যবসা করেন মো. জালাল উদ্দিন। জালাল উদ্দিন জানান, ১১ মাসই এ মন্দিরের প্রবেশপথে কড়া পাহারা থাকে। কিন্তু রোজার মাসে এ মন্দিরের প্রধান গেট রোজাদারদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

এ মন্দিরে ৪০ জন বৌদ্ধভিক্ষু আছেন। তাদের ধর্মে সংসার ধর্ম করলে বৌদ্ধভিক্ষু হওয়া যাবে না। ফলে তারা ব্যক্তিজীবনের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন। পুরো জীবনটা মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তারা। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিহারে সাতশ’রও বেশি অনাথ শিশু আছে। বিহারই তাদের পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে।

বৌদ্ধ মহাবিহারের প্রধান শুদ্ধানন্দ মহাথের। তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি সংঘনায়ক। ৮৬ বছর বয়সী এ ভিক্ষুর জীবন কাটছে মানুষের সেবায়। বিহারকে দুস্থদের ঠিকানায় রূপ দিয়েছেন তিনি।

ইফতার বিতরণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের সংযমের মাস রমজান। তাদের কাছ থেকেও আমরা সংযম শিখি। মানুষ মানুষের জন্য, মানবতার সেবাই সবচেয়ে উত্তম ধর্ম। সব ধর্মই সম্প্রীতির কথা বলে। এ সম্প্রীতি বজায় রাখলেই বিশ্ব শান্তিময় হবে। মানুষে-মানুষে বন্ধুত্ব ও প্রীতি বাড়বে। একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। সমাজ শান্ত হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামবে। ভালোবাসা দিয়ে থামাতে হবে হানাহানি। আমরা এক হব, ভালো থাকব, সুখে থাকব।’

ইফতার দেওয়ার চিন্তা কেন এলো? শুদ্ধানন্দ মহাথের বলেন, আমাকে এলাকার মানুষ ‘বড়দা’ বলে। রমজানে এলাকায় ঘুরে দেখেছি দরিদ্র মানুষের ইফতার করার টাকা নেই। তখন মহারাজিকের সব ভিক্ষুর সঙ্গে আলোচনা করে ইফতার বিতরণের এই সিদ্ধান্ত নেই। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষে-মানুষে বন্ধুত্ব ও প্রীতি বাড়াতে সহযোগিতা করা দরকার।

শুদ্ধানন্দ মহাথের বলেন, “ধর্ম হচ্ছে মানুষের ইহজাগতিক বিশ্বাস। এটা কে কেমনভাবে পালন করবে তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু মানুষ বড় সত্য। ‘সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু’ জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক, জগতের সকল প্রাণী তার কর্মের মধ্য দিয়ে কল্যাণ লাভ করুক_ এটাই হচ্ছে ধর্মের মূল কথা।”

শুদ্ধানন্দ মহাথেরের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। তখনও দু-একজন কিছুক্ষণ পর পর এসে ইফতার নিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে। ইফতার মুখে তুলতে তুলতেই ছোট্ট করে বললেন, ‘আমার স্বপ্ন, এই মন্দির যতদিন থাকবে, ততদিন যেন এই ইফতার আয়োজন থাকে। ধীরে ধীরে তা যেন আরও বাড়ে।’

পাঠকের মতামত

সীমান্তের তুমব্রু থেকে বিজিবির অভিযানে কোটি টাকার ক্রিস্টাল‌ মেথ আইস উদ্ধার

বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ‍্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর চিকন পাতা বাগানের পাহাড়ে ৩৪ ...

সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে – র‍্যাব সিও

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ, ছাত্র-জনতা ও গণমাধ্যমকর্মী সহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে কক্সবাজার ...