প্রকাশিত: ১০/০৩/২০১৭ ১২:০৩ পিএম
নিউজ ডেস্ক::

‘এলাকা মাদকে ভরে গেছে। ছোট ছোট ছেলেরা বাবা (ইয়াবা) খায়। আমার এক আত্মীয়ও ইয়াবা খায়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন…। ’ র‌্যাবের কাছে অভিযোগ জানানোর অ্যাপ ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’-এ সম্প্রতি এমনই একটি বার্তা দেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার এক ব্যক্তি। ‘মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকা মাদকের আখড়া। রাত হলেই মাদকসেবীদের উপদ্রব বেড়ে যায়। এলাকার যুবক ও কিশোররা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি ইয়াবা। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে যাচ্ছে। ’ পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাপ ‘ওপিনিয়ন অর কমপ্লেইন’-এ অভিযোগ করেন মিরপুর ১৩ নম্বরের এক বাসিন্দা। এভাবে র‌্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’, পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ ও ‘বিডি হেল্প  লাইন’ নামের অ্যাপসে প্রতিদিনই মাদকদ্রব্যের ব্যাপারে অভিযোগ করছে ভুক্তভোগী মানুষ। জঙ্গি ও নাশকতার বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে তথ্য পাওয়ার জন্য এসব অ্যাপস চালু করা হয়েছিল। তবে সব অ্যাপস ভরে যাচ্ছে মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত অভিযোগে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করছে মাদকদ্রব্যের বিষয়ে। অন্যান্য অভিযোগের তুলনায় মাদকের অভিযোগ ১০ গুণেরও বেশি। কোনো কোনো সময় মোট অভিযোগের ৮০ শতাংশই মাদকসংক্রান্ত। এর মধ্যে ইয়াবাসংক্রান্ত অভিযোগ বেশি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় অভিযান চালানো না গেলেও মাদকের তথ্য গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ ও র‌্যাব।

পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ মামলা হয় তার প্রায় অর্ধেক মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত। এই মাদকের মামলা বা ঘটনার বেশির ভাগই ইয়াবাসংক্রান্ত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে সব ধরনের মামলার যে আলামতগুলো পরীক্ষা করতে পাঠানো হয় তার ৬০ শতাংশই ইয়াবার। আর ডিএনসির রাসায়সিক ল্যাবে পরীক্ষা করা আলামতগুলোর ৮০ শতাংশই ইয়াবার।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকদ্রব্য সব ধরনের অপরাধের মূল। সন্ত্রাসী গ্রুপের হামলা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নাগরিক জীবনে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন অপরাধ কিছুটা এখন কমেছে। তবে মাদকের কারণে মানুষ পরিবার-পরিচয় নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছে। এই মাদকের আগ্রাসন বাড়িয়েছে ভয়ংকর নেশা ইয়াবা।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘মাদকের সঙ্গে অপরাধের সরাসরি সম্পর্ক। তরুণদের প্ররোচিত করে অপরাধে ঠেলে দিতে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই মাদক যত বাড়ে সমাজে অপরাধ তত বাড়ে। পরিবারগুলো সরাসরি আক্রান্ত হয়। এ কারণেই ইয়াবা আর মাদক নিয়ে জনজীবনে এত উৎকণ্ঠা। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই অবস্থা মনিটরিং করা জরুরি। কমিউনিটি পুলিশসহ মাঠপর্যায়ে কাজ করে এমন শাখাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। ’

ইয়াবা থেকে মুক্তি চেয়ে অভিযোগ : গত বছরের ১১ জুলাই র‌্যাব চালু করে রিপোর্ট টু র‌্যাব (জবঢ়ড়ত্ঃ ২ জধন) নামের অ্যাপ।   চালুর পর থেকে গত মঙ্গলবার (৮ মার্চ) পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’-এ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ মাদকের ব্যাপারে। তিন হাজার ৬৭৭টি বার্তায় ভুক্তভোগীরা রাজধানীসহ সারা দেশে মাদকের আগ্রাসনের তথ্য দিয়েছে। এই অভিযোগের হার মোট অভিযোগের ২২.৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অভিযোগ এসেছে সোস্যাল মিডিয়া ওয়াচ থেকে, এক হাজার ১৪০টি, যা মোট অভিযোগের ৬.৯২ শতাংশ। রিপোর্ট টু র‌্যাব-এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য এসেছে এক হাজার ১০৬টি। সন্ত্রাসী আক্রমণের ব্যাপারে তথ্য এসেছে ৬৩৬টি, এ ছাড়া ডাকাতির ৪৪৩টি, অপহরণের ২৫৮টি, হত্যার ২৬৬টি, নিখোঁজসংক্রান্ত ২৫৪টি অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘অ্যাপটি চালুর পর আমরা ব্যাপকভাবে সাড়া পেয়েছি। সব ধরনের তথ্যই যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নে পাঠানো হয়। ’

গত ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট চালু করে হ্যালো সিটি (ঐবষষড় ঈঞ) নামের আরেকটি অ্যাপ। সেদিন থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হ্যালো সিটি’র এক হিসাবে দেখা যায়, মোট তিন হাজার ৮৮টি অভিযোগ সেখানে জমা পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৬৯টি অভিযোগ ছিল মাদকসংক্রান্ত। এ ছাড়া জঙ্গিসংক্রান্ত ৮০৫, সাইবার ক্রাইম ৭২৭ এবং আন্তর্দেশীয় অপরাধের ব্যাপারে ৬৮৩টি বার্তা আসে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক দফায় ডিএমপির মিডিয়া বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হ্যালো সিটির হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিটি অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বরে চালুর পর ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ‘ওপিনিয়ন অর কমপ্লেইন’-এ ৬০০ অভিযোগ করে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে জমি দখল ও সম্পত্তির বিরোধসংক্রান্ত অভিযোগ ২২৫টি, মাদক ব্যবসার অভিযোগ ১০০টি, সাইবার ক্রাইম ১০০টি এবং জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার ৩০টি। পরবর্তী সময়ে যেসব অভিযোগ পড়ছে এর মধ্যে মাদকের অভিযোগই বেশি বলে জানায় সূত্র।

একাধিক সূত্র জানায়, অ্যাপসে মাদকের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই ইয়াবাবিষয়ক। কেউ এলাকায় ইয়াবার ব্যবসা চলছে বলে জানাচ্ছে; কেউ ইয়াবা বিক্রেতার নাম ও অবস্থানের ব্যাপারে তথ্য দিচ্ছে; কেউ ইয়াবা ও গাঁজা সেবনের স্পট সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় ইয়াবাসহ মাদক সেবন করে এমন ব্যক্তির নামের তালিকাও পাচ্ছে অনেকে। থানায় নিয়মিত মামলা, নিজস্ব সোর্স এবং অভিযোগের পাশাপাশি অ্যাপসে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীতে বেশ কিছু ইয়াবার কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব।

অ্যাপসে অভিযোগের তথ্যের সূত্রে মিরপুরের পীরেরবাগ, শেওড়াপাড়া ও যাত্রাবাড়ীতে সরেজমিনে খোঁজ নেয় কালের কণ্ঠ। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার রাশেদ হাসান, কামরুল ইসলাম ও মোবারাক হোসেনসহ কয়েকজন বলেন, প্রতিটি মহল্লায় ১৬ থেকে ২৫ বছরের ছেলেদের আড্ডা হয়। এরা সন্ধ্যার পরই গলিতে গিয়ে নেশা করে। সবাই ইয়াবায় আসক্ত। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হলি ক্রিসেন্ট স্কুল গলির সৌরভ ও রুবেল নামের দুই তরুণ হত্যা করে তাদের বন্ধু সজীবকে। এই গ্রুপটিও ইয়াবা সেবন করত।

যাত্রাবাড়ীর করাতিটোলার বাসিন্দা পপি আক্তার বলেন, ‘আমাদের এই এলাকার অনেক ছেলে ইয়াবায় শেষ হইয়া গেছে। আমার ছোট ভাই শফিকরে এই মাদক খাইয়া ফেলছে। নেশার জন্য ও বাসার সব জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। ’

মাদকের মামলাই বেশি : পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ১৩ হাজার ৮৯০টি মামলা হয়, যার মধ্যে চার হাজার ৩৮৮টি মাদকদ্রব্য আইনের। এ ছাড়া ১৫ ধরনের মামলার মধ্যে হাজারের অঙ্ক ছাড়িয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা, এক হাজার ৪৮২টি। জানুয়ারি মাসের মোট ১৫ হাজার ৭৮২ মামলার ছয় হাজার ৮০৬টি মাদকের। গত ডিসেম্বরের ১৫ হাজার ৩২টির মধ্যে মাদকদ্রব্যের মামলা ছিল ছয় হাজার ১৬৬টি। একইভাবে ২০১৫ সালের মোট মামলা এক লাখ ৭৯ হাজার ৮৮০টির মধ্যে মাদকের মামলা ছিল ৪৭ হাজার ৬৯২টি। ২০১৪ সালে মোট মামলা এক লাখ ৮৩ হাজার ৭২৯টি এবং মাদকের মামলা ৪২ হাজার ৫০১টি।

ডিএমপির অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ১২ মাসে রাজধানীতে ১৯ হাজার ৯০০টি মামলা হয়েছে। ২৩ ধরনের মামলার মধ্যে অর্ধেকই মাদকের, ৯ হাজার ৬২৭টি। ১২ মাসে অন্যান্য অপরাধের তুলনায় ৮০ শতাংশেরও বেশি মাদকের।

পরীক্ষাগারে বেশি ইয়াবা আলামত : মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত মামলায় আলামতগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে। অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা এখন দেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আলামতগুলোর ৮০ শতাংশই ইয়াবার। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ল্যাবে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মামলার আলামত অর্থাৎ মাদকদ্রব্য আমরা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেই। সেই হিসাবে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের বেশি ইয়াবার আলামত পরীক্ষা করা হয়। ’

সিআইডির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দিলীপ কুমার সাহা জানান, দেশে মাদকের বিশেষ করে ইয়াবার ব্যবহার বাড়ছে। ল্যাবে পাঠানো নমুনার বেশির ভাগই মাদকের। এর মধ্যে ইয়াবার আলামত সবচেয়ে বেশি। ল্যাবের মোট আলামতের অর্ধেকেরও বেশি ইয়াবার।

পাঠকের মতামত

মৎস্য খাতের অগ্রযাত্রায় নেদারল্যান্ডস-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ

মৎস্য খাতের টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে নেদারল্যান্ডস সরকার। বিশেষত কৃষি ও জলজ ...

সন্তান কোলে হেলিকপ্টারে করে বিয়ে, পরকীয়ায় স্ত্রী পালানোর ‘জবাব’ দিলেন স্বামী

দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ এলে অনেকেই ভেঙে পড়েন, অনেকে দীর্ঘ সময় বিষণ্নতায় কাটান। তবে মুন্সিগঞ্জের কামাল ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার বিষয়ক ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিশেষ ...

নাফ নদের ৩৩ কি.মি. ও সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ২০ কিমিতে বসেছে ৬ রাডারসীমান্ত ও সমুদ্রে নজরদারিতে রাডার ড্রোন থার্মাল ক্যামেরা

এবার দেশের সীমান্ত ও সমুদ্র সুরক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নজরদারি রাডার, ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরা যুক্ত ...

তদন্তের নির্দেশ চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজিকেটেকনাফে হত্যা মামলার এজাহার পাল্টে দিল পুলিশ

কক্সবাজারের টেকনাফে একটি হত্যা মামলার এজাহার পুলিশ কর্মকর্তারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন- এমন অভিযোগে আদালতে মামলা ...