প্রকাশিত: ০৪/০৭/২০১৭ ৪:১২ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:২০ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::

গতকাল সোমবার ভোরে নিখোঁজ হওয়ার ১৮ ঘন্টা পর নাটকীয়ভাবে রাতে উদ্ধার হন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে নাটকের যেন শেষই হচ্ছে না।

যেভাবে নিখোঁজ হলেন
এদিন ভোর ৫টায় রিং রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ বলে তার স্বজনরা আদাবর থানায় গিয়ে অভিযোগ জানান। স্ত্রী ফরিদা আখতার সাংবাদিকদের বলেন, ফরহাদ মজহার ভোরে লেখালেখি করেন। সাধারণত বের হন না। এদিন ভোরেও কম্পিউটারের সামনে স্বামীকে দেখেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির মধ্যে একটি ফোন পান। তাতে ফরহাদ মজহার বলেন, তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে।

ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ পুলিশের অন্য সদস্যরা হক গার্ডেনে ফরহাদ মজহারের বাসায় যান। ফরহাদ মজহার সকাল ৫টা ৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বলে সিসিটিভি ভিডিওতে দেখে যায়।

সেসময় পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার বলেন, ‘আমরা ফরহাদ মজহারের ফোন ট্র্যাক (অবস্থান শনাক্ত) করে জানতে পেরেছি, কখনো তাঁর অবস্থান আরিচা, ফরিদপুর বা কখনো মাগুরায়। ওনার লোকেশন পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা তাঁকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

বিএনপির দাবি
ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। দলের পক্ষে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমরা যেটা মনে করি, সরকারের অজান্তে এই ঘটনা ঘটেনি। সরকারের কোনো এজেন্সি বা কোনো টিম এই ঘটনার সাথে জড়িত। এই অপহরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আর যাতে কেউ কলম না ধরতে পারে, আর যাতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ যে গুমরে গুমরে মরছে, এটা যেন বাঙময় হয়ে খবরে কাগজে অথবা অন্য কোথাও প্রকাশিত হতে না পারে। নিস্তব্ধ-নীরব হয়ে যায় যেন মানুষ। আর তাই পরিতৃপ্তি সহকারে এই দুঃশাসনের অধিকর্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী রাজত্ব করে যাবেন।’

বিএফইউজে ও ডিইউজের একাংশের উদ্বেগ
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ফরহাদ মজহার গুম, খুন, অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিস্ময়করভাবে তাঁকেই অপহরণের শিকার হতে হয়েছে।

অ্যামনেস্টির উদ্বেগ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলেছে, বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহার কোথায় আছেন বিষয়টি শনাক্তকরণ এবং তাকে উদ্ধারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উচিত নিখোঁজ বাংলাদেশী কবি ফরহাদ মজহার কোথায় আছেন বিষয়টি চিহ্নিত করা এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

খালেদা জিয়ার টুইট
নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১৬ ঘন্টা পর তার সন্ধান দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সোমবার সাড়ে ৯টার দিকে তার টুইটার অ্যাকউন্টে ফরহাদ মজহারের মুক্তি চেয়ে টুইট করা হয়। টুইটে লেখা হয়েছে, ‘ফরহাদ মজহারকে এখনি তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় এর দায় সরকারকে নিতে হবে। এটি শাসকচক্রের আরেকটি নিষ্ঠুর কর্ম।’

স্ত্রীকে ফোন এবং টাকা দাবি
ভোরে নিখোঁজ হওয়ার পর এদিন বিকাল পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের ফোন থেকে তার স্ত্রীফ রিদা আখতারের কাছে পাঁচবার ফোন এসেছিল বলে জানান পরিবারের এক সদস্য। শুরুতে ৩৫ লাখ টাকা দাবি করা হলেও সর্বশেষ ফোনালাপে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা টাকার বিষয়ে চিন্তা করছি না। সুস্থভাবে তার ফিরে আসাটাই মূল লক্ষ্য।’

ফোন নাম্বার ট্র্যাক এবং অবস্থান শনাক্ত
এদিন সন্ধ্যার দিকে ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তিনি খুলনা এলাকায় আছেন বলে নিশ্চিত হন পুলিশ কর্মকর্তারা। এরপর সেখানে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

১৮ ঘন্টা পর উদ্ধার
পুলিশ ও র্যা বের অভিযানের একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে যশোরের অভয়নগরের বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলসের সামনে থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, নওয়াপাড়ায় পাওয়ার পর ফরহাদ মজহারকে প্রথম অভয়নগর থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে খুলনায় আনা হয়েছে। রাত দেড়টার দিকে তাকে ঢাকার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ফরহাদ মজহারের ‘নাটক’
উদ্ধার করার পর পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে, সেভাবেই তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল, গেঞ্জি ছিল। কিছু টাকাও ছিল। এমনকি মোবাইল চার্জার নিতেও ভোলেননি তিনি।এতে করে অপহরণের বিষয়টি প্রমাণ হয় না। মনে হয় না এটা অপহরণ।’

সেক্ষেত্রে ফরহাদ মজহার অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন বলে মনে করেন কি না- সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তাই মনে হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বা পারিপার্শ্বিকতায় এটাই প্রমাণ করে যে উনি স্বেচ্ছায় ঘর থেকে বের হয়েছেন। তবে আরও তদন্ত করতে হবে।’

সকালে ঢাকায় আনা

সোমবার রাতে যশোর থেকে উদ্ধার করার পর ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় আনা হয় মঙ্গলবার সকালে। এদিন সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর আদাবর থানায় তাকে নিয়ে আসে পুলিশ। সকালে আদাবর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, একটু আগে ফরহাদ মজহারকে খুলনা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে তিনি আদাবর থানায় আছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

পুলিশের সংবাদ সম্মেলন
ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন, সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর উনি নিজের মোবাইল ফোন থেকে স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, ৩৫ লাখ টাকা দিলে উনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা এখন জানার চেষ্টা করছি কারা উনাকে নিয়ে গিয়েছিল।’

সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা আড়াইটার দিকে ফরহাদ মজহারকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হবে জানিয়ে আবদুল বাতেন বলেন, তার জবানবন্দির ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত