ডেস্ক নিউজঃ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে নাটকীয় রূপান্তর ঘটেছে। আগের শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক থেকে স্থায়ী কৌশলগত অংশীদারিত্বের পর্যায়ে চলে গেছে সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল চীন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চীন এমনকি জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার প্রশ্নের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটোও দিয়েছে। এরপর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বাংলাদেশ আজ চীনকে সব সময়ের বন্ধু ও বিশ্বাসযোগ্য মিত্র মনে করে। ২০১৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় দুই দেশ কৌশলগত সম্পর্কও স্থাপন করেছে।
চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের শুরু ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পরেই এই সম্পর্ক শুরু হয়। মুজিবুর রহমানের পর যে সামরিক একনায়ক ক্ষমতায় আসেন, তিনি বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো চীন সফর করেন। এই সফরে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় এরপর থেকেই সেটা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। চীনের সাথে নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশের একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং গণতান্ত্রিক সরকারও এই সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়। নির্বাচিত সরকারের প্রতিনিধিরাও প্রায় নিয়মিত চীন সফর করেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জুনে চীন সফর করেন। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের অনেক মাত্রা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, রাজনৈতিক এবং জনগণের পর্যায়ে সম্পর্ক রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। একমাত্র চীনের সাথেই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে অস্ত্র রফতানিকারক সবচেয়ে বড় দেশ হলো চীন। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধিকাংশ অস্ত্রাদি চীন থেকে আমদানি করা। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাঙ্ক, মিসাইল লঞ্চার, জঙ্গি বিমান এবং আরও কিছু অস্ত্র সিস্টেম। সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে দুটো মিং শ্রেণীর সাবমেরিন কিনেছে বাংলাদেশ। তাছাড়া, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয় চীন। চীনা অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী চীনের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।
অর্থনৈতিক সম্পর্কও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার। তবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে অনেক – ৯ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক-মুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে চীন। এরপরও বাণিজ্য ঘাটতি কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া চীন বাংলাদেশে বিশেষ করে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগও করছে।
চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চীন বাংলাদেশে ব্রিজ, সড়ক, রেললাইন, বিমানবন্দর এবং বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে। চীনের উন্নয়ন সহায়তা আসে মূলত ক্রেডিট হিসেবে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ২৪ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে চীন নিজেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও উন্নতির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। বাংলাদেশে চীনের যে জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছে, সেটাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগিয়েছে চীন। সার্কের পর্যবেক্ষক হওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের সহযোগিতা অর্জন করেছে তারা। আবার বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কর্মসূচিতেও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে তারা।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক সাধারণভাবে উষ্ণ হলেও এমন লক্ষণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ হয়তো চীনের ইঙ্গিতে উঠানামা করবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সালে সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীন যে শর্ত দিয়েছিল, তাতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ।