ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ৩১/০৩/২০২৪ ৪:০২ এএম

কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলার পানখালি এলাকার বাসিন্দা নজির আহমদ (৫৮)। গেল একবছর আগে ছেলে মাহমুদ হোসেনসহ অপহরণের শিকার হন। নজির আহমদ বলেন, ছেলেসহ ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছি। আরও এক লাখ টাকা খরচ করেছি ফিরে এসে চিকিৎসা করাতে গিয়ে।

অপহরণের পর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে নজির আহমদ বলেন, ওরা (অপহরণকারী) আমাদের গরু বলে ডাকে। পাগুলোকে বেঁধে কাঠের পাটাতন দিয়ে পিটিয়েছে। মুক্তিপণ দিতে দেরি হচ্ছিল বলে তিনবার কেটে ফেলতে চেয়েছিল তারা।

অসহ্য নির্যাতন সহ্য করে ফিরে আসার পর মুক্তিপণ দেওয়া নজির আহমদ এখন নিঃস্ব। অভাবের ঘরে তারপরও ভয় নিয়ে জীবিকার তাগিদে যেতে হয় পাহাড়ের পাদদেশে ফসলের মাঠে।

পুলিশের কাছে নিজ থেকে অভিযোগ না দিলেও ক্ষোভ জানিয়ে নজির আহমদ বলেন, কেউ খবর নেয়নি। পুলিশও আসেনি। অপরাধীও ধরা পড়েনি।

সীমান্তের সর্বশেষ উপজেলা টেকনাফের পাহাড়গুলো এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। গহীন পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা গড়ে তুলেছে আস্তানা। এক বছরে যেখানে অপহরণের শিকার হয়েছে প্রায় ১২০ জন। যাদের বেশিরভাগ ফিরেছে মুক্তিপণ দিয়ে।

সর্বশেষ গেল সপ্তাহে অপহরণের শিকার হয় আরও ১৩ কৃষক। যারা ফিরেছে মুক্তিপণ দিয়ে। এরমধ্যে হ্নীলার পানখালী এলাকার মোহাম্মদ নুর ফিরেছে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে। নুরের বাবা আব্দুর রহিম বলেন, ২১ মার্চ অপহরণ করে ২৪ মার্চ ফিরিয়ে দেয় আমার ছেলেকে। হ্নীলা থেকে তুলে নিয়ে শামলাপুরের বাহারছড়ায় ছেড়ে দেয় ৩ দিন পর।’

নুরের মা বলেন, ধারকর্জ করতে গিয়ে পাড়ার মানুষ বাকি রাখি নাই। মেয়েদের স্বর্ণ বন্ধক দিয়েছি, কড়া সুদে লোন নিয়েছি। ছেলেকে বাঁচাতে এভাবে যোগাড় করেছি মুক্তিপণের টাকা।

পুলিশের উপর ক্ষোভ

অপহৃতদের এক স্বজন (নাম না প্রকাশ করার শর্তে) বলেন, আমার ছেলেটা ফিরে আসার পর এক গ্লাস পানিও খেতে পারেনি। পুলিশ এসেই হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে তুলে নিয়ে গেছে। এখন শুনছি তাদের কক্সবাজারে কোর্টে নিয়ে গেছে।

অপহরণের শিকার এক যুবকের মা বলেন, গতকাল ফেসবুকে দেখলাম পুলিশ নাকি উদ্ধার করেছে। অথচ ডাকাতদের টাকা দিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছি।

পুলিশের উদ্ধার করার কৃতিত্ব নিয়ে ক্ষোভ জানালেন টেকনাফের পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা। পানখালি এলাকার এক দোকানদার বলেন, পাহাড়ে তেমন কোনো অভিযান চালায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপহরণের পর দুই এক মাইল হেঁটেই চলে আসেন তারা। অথচ তারা চাইলেই ড্রোন কিংবা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে অভিযান চালাতে পারতেন। গরীব মানুষগুলো মুক্তিপন দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, অপহরণের পর ফিরে আসাদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া ছাড়া মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো তদন্ত নেই পুলিশের। তাই অপহরণের মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতিও নেই।

পুলিশের বক্তব্য

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসমান গণির সঙ্গে কথা হয় তার কার্যালয়ে বসেই। তিনি অন রেকর্ড অস্বীকার করেন সর্বশেষ ফিরে আসাদের মুক্তিপণের বিষয়টি।

ওসমান গণি বলেন, মুক্তিপণের বিষয়টি আমার জানা নেই। পাহাড়ে যখন অভিযানে যাই, আমরা তাদের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ার কারনে ডাকাতরা অপহৃতদের ছেড়ে দিয়েছে। এমন বক্তব্য ভুক্তভোগীরা তাকে দিয়েছে বলে দাবি করেন ওসি ওসমান গনি।

অপরাধী ধরা না পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, অপহরণকারীরা যেসব মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেন, তা দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধিত। যার কারণে পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। তাই তথ্য প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়েও লাভ হয়না এখানে। রোহিঙ্গা এবং স্থানীয়রা মিলে সংগঠিত ভাবে এসব অপরাধগুলো করছে।

এছাড়াও বেশিরভাগ অপহরণ মাদককে ঘিরে হচ্ছে জানিয়ে ওসমান গণি বলেন, মাদকের বিনিময়ে টাকা লেনদেন করতে গিয়ে অনেককে আটকে রাখেন অপরপক্ষ। অনেকে আবার মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে টেকনাফে আসে। মানবপাচারকারীরাও এসবে জড়িত।

গেলো এক বছর কী পরিমাণ অপহরণের মামলা ও কতজন অপরাধী আটক হয়েছে তার হিসেব জানতে চাইলে তার কোনো পরিসংখ্যন করা নেই বলে জানান ওসি।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও বনবিভাগকে দুষলেন জনপ্রতিনিধি

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় খুব সহজেই রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অপরাধীরা ব্যবহার করেছন এসব কাজে। অপরাধ করেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে ঢুকে যান। তাই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, পাহাড়ের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের জানার কথা কোথায় কে কি করে! গহীন পাহাড়ে কোথায় কি আস্তানা করেছে এসব বনবিভাগের জানার কথা। প্রতিমাসে আইনশৃংখলা সভা হয়, কিন্তু বনবিভাগ এসব কিছুই জানায় না।

ঘটনা ঘটলেই শুধু কথা ওঠে, ফিরে আসার পর আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারনে একের পর এক অপহরণ হচ্ছে। তাই যৌথ বাহিনীর বিশেষ সেল গঠন করে পাহাড়ের ভিতরে কার্যকর অভিযান চালাতে হবে।’

মাছ ধরার নাফ নদীও বন্ধ পাহাড়ও বন্ধ, জীবিকার তাগিদে মানুষ কোথায় যাবে? এমন মন্তব্য জুড়ে দিয়ে স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধি মনে করেন ওই অঞ্চলে অপরাধ আরও বাড়তে পারে।

স্থানীয়রা নিরাপত্তা চায়

সবমিলিয়ে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠা টেকনাফের পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন নিরাপত্তা নিয়ে। হ্নীলার কোনাখালী এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল মাহমুদ বলেন, এখানে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ফসলি জমি পাহারা দিতে হয় হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষায়। কিন্তু জমি পাহারা দিতে গিয়ে শিকার হতে হয় অপহরণের। তাই সবমিলিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা। সুত্র: দেশটিভি

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে ইউনাইটেড নেশন টিম

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ইউনাইটেড নেশন ফোরাম বাংলাদেশ স্টাডি প্রোগ্রাম (BSP) এর ...

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ধর্ম ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো “বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয়” শীর্ষক আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ...