ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ০৫/০৪/২০২৪ ১২:১৩ পিএম

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে রেললাইন নির্মাণ করা হলেও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত যাচ্ছে না চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ। মিয়ানমারের অনাপত্তি না পাওয়ায় থেমে যাচ্ছে কক্সবাজারেই। এখন দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথে। ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন।

ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ না যাওয়ায় কমবে প্রকল্প খরচ। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় কমছে। প্রকল্প খরচ কমলেও আট বছর আগে করা রেলওয়ের পরিকল্পনার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।

১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার অংশ নির্মাণে ডিপিপিতে খরচ ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই অংশ নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। খরচ কমেছে ৩ হাজার ৭৪১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণে ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৫৫৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। এই অংশ নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ পড়ায় এক টাকাও ব্যয় হয়নি। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খরচ কমেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং রেলের প্রকল্প যাচাই কমিটির সভা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২০ মার্চ এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির সভা হয় সংসদে। আর গত সোমবার রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে হয় যাচাই কমিটির সভা। ডিপিপি সংশোধন করে ব্যয় কমিয়ে প্রকল্প মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় যাচাই সভা থেকে।

স্থায়ী কমিটির সভার সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের অনাপত্তি না পাওয়ায় রামু থেকে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তাই এই অংশ বাদ দিয়েই সরকারের অগ্রাধিকারের (ফাস্ট ট্র্যাক) এ প্রকল্পটি সমাপ্ত করা হবে। যদিও এই অংশে রেলপথ নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে ৮৮টি স্পটে ৬৪০টি খুঁটি স্থাপন করে প্রায় সাড়ে ১৮ কিলোমিটার নতুন বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা হয়। পুরোনো সোয়া ১৫ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন অপসারণ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে গত বছর আরও সোয়া ৩ কিলোমিটার নতুন বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করা হয়েছে। রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ যাওয়ায় এসব বৈদ্যুতিক লাইনের উপযোগিতা পাওয়া যাবে না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড ও চীন যাবে। নেটওয়ার্কে যুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রেলপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের পরিকল্পনা রয়েছে। সামরিক শাসনের কবলে পড়া মিয়ানমার এ পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে যাওয়ায় দেশটির সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে না বাংলাদেশের। রেলপথ মন্ত্রণালয় যদিও বলছে ভবিষ্যতে নির্মাণ করা হবে। তবে প্রকল্পের সমাপ্তি টানায় সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি কমছে। প্রকল্পের ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু দেশটি রেললাইন নির্মাণে আগ্রহ দেখায়নি। তাই সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন যাচ্ছে না।

এতে ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চীন এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল কিনা– প্রশ্নে রেল সচিব বলেন, মিয়ানমার রাজি না থাকলে বাংলাদেশ কী করতে পারে। মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার মতো নয়।

ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে ২০০৭ সালের নভেম্বরে চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হতে মিটারগেজ রেললাইনের বদলে বাড়তি খরচে ব্রডগেজ এবং ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করছে বাংলাদেশ।
কক্সবাজারকে মিটারগেজ রেলপথের মাধ্যমে ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন করে সরকার। ওই সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ছাড়াই খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ সম্পন্নের পরিকল্পনা ছিল। তবে সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা হয় ২০১৬ সালে। তাতে খরচ বাড়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্প মেয়াদ ২০১৬ থেকে ছয় বছর বাড়ানো হয়। পরবর্তী সময়ে তা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

দোহাজারী-চকরিয়া পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন। দ্বিতীয় প্যাকেজে চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার অংশের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালের মার্চে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।

প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী, এডিবির ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্প খরচ কমে যাওয়ায় বিদেশি ঋণও কমবে। ডিপিপির প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী, এডিবি দেবে ৮ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। বাকি ৩ হাজার ৬৮ কোটি বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশ সরকার। এডিবিরি সঙ্গে গত জুন পর্যন্ত তিন ধাপে ১ হাজার ১০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে।

ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধনী অনুযায়ী প্রকল্প খরচ কমে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী।

যাচাই কমিটির সভার তথ্যানুযায়ী, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার অংশ নির্মাণে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে ২৪ শতাংশের বেশি কম টাকা খরচ হবে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের দাম আচমকা না বাড়ালে এবং যুদ্ধে আমদানি ব্যাহত না হলে নির্মাণ ব্যয় আরও কমত।

২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯৪ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথের। মাত্র ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ডিপিপিতে কীভাবে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে– এ প্রশ্নও উঠছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেন, ডিপিপি প্রণয়নে সরকারি কর্মকর্তাদের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে, যার উদাহরণ এই প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ৪-৫ শতাংশ ব্যয় কমবেশি হতে পারে। কিন্তু রেলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রকল্পে কাজের শুরুর পর খরচ কয়েক গুণ বাড়ছে, আবার কোথাও অস্বাভাবিক কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ সমীক্ষা, নকশা ও ডিপিপি ঠিকভাবে হয়নি।

আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন করা রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৪ শতাংশ খরচ কমেছে।

দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের দুটি প্যাকেজে ঠিকাদারদের সঙ্গে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি এবং ৩ হাজার ৫০২ কোটি টাকার চুক্তি করেছে রেলওয়ে। সেই সময়কার দর শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ করেছিল রেলওয়ে। পরিকল্পনা ঠিকমতো হলে খরচ আরও কমত কিনা– প্রশ্নে রেল সচিব বলেন, প্রয়োজনীয় টাকাই খরচ করা হয়েছে। ঠিকাদারদের বাড়তি টাকা দেওয়া হয়নি। প্রকল্প পরিকল্পনা, সমীক্ষা, ডিপিপি প্রণয়নে রেলওয়ের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তা অস্বীকার করা যাবে না।

নথি সূত্রে জানা গেছে, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার অংশে জমি অধিগ্রহণে খরচ কমেছে ১৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পুনর্বাসনে ১৬৭ কোটি, মাটির কাজে ৯৭১ কোটি, রেল ট্র্যাক নির্মাণে ১৯৪ কোটি, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে ১ হাজার ২১৭ কোটি, সিডি-ভ্যাট বাবদ ৪৮৪ কোটি, ফিজিক্যাল কন্টেজেন্সিতে ৬১৯ কোটি এবং প্রাইস কন্টেজেন্সিতে ৩৬০ কোটি খরচ কমেছে। তবে আনুষঙ্গিক খাতে প্রায় ৫৭৯ কোটি টাকা খরচ বেড়েছে। কীভাবে এত বেড়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে সম্মানী বাবদ ২০ লাখ, ভ্রমণে ২ কোটি ৯১ লাখ, গাড়ির নিবন্ধনে ৫০ লাখ, অফিস আসবাব বাবদ ৩৮ লাখ টাকা নতুন করে কেন বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত

রামুর ফতেখাঁরকুলে উপ-নির্বাচনে প্রতীক পেয়ে প্রচারনায় ৩ চেয়ারম্যান প্রার্থী

রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের উপ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধি ৩ প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্ধ দেয়া ...

টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর মনিরুজ্জামানের সম্পদ জব্দ দুদকের মামলা

টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মো. মনিরুজ্জামানের সম্পদ জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ স্পেশাল ...