চলমান দশম জাতীয় সংসদের এমপিদের প্রায় সবাই কোটিপতি। শতশত কোটি টাকার মালিকও রয়েছেন অনেক। এদের সিংহভাগই (৬৯ শতাংশ) আবার ব্যবসায়ী। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় সংসদ সচিবালয়কে এমপিদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানানো তথ্য পর্যালোচনায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, বর্তমান সংসদের এমপিরা শুধু বাংলাদেশের রেকর্ড নয়, উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সংরক্ষিত নারী এমপিরা বাদে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের ৩০০ এমপির মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি এমপি ব্যবসায়ী। যা বিশ্বে নজিরবিহীন। শুধু পেশা ব্যবসার দিক থেকেই নয়, অর্থ-সম্পদের মালিকানার দিক থেকেও বাংলাদেশের এমপিরা বিশ্বে অনন্য। হাতেগোনা কয়েক এমপি ছাড়া বাকি সবাই কোটিপতি।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমপিদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেয়া তথ্যমতে চলতি সংসদের এমপিদের মধ্যে ২১৪ জনই ব্যবসায়ী। ৪৮ জন রয়েছেন আইনজীবী। আর রাজনীতিকে পেশা বলেছেন মাত্র ২২ জন। ব্যবসায়ী মোট ২১৪ জন এমপির মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলিয়ে ৬ জন।
সূত্র মতে, মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে কোটিপতি ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। এরপর সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের ডেকে ডেকে এমপি করা হয়েছে। মাত্র ৬ বছরে ১৯৭৯ সালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এরপর এ ধারা বাড়তেই থাকে। ১৯৯৬ সালে এসে কোটিপতি ব্যবসায়ী এমপির হার হয়েছে ৪৮ শতাংশ, পরে ২০০১ সালের সংসদে এ হার হয় ৫১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে হয় ৬৩ শতাংশ।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও অতীতের ধারাবাহিকতায় মোট এমপির চারভাগের প্রায় তিনভাগই দখল করেছেন কোটিপতিরা। রীতিমতো কোটিপতি এমপির ছড়াছড়ি। সদ্য নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের কোটিপতি এমপির সংখ্যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) একটি গবেষণা অনুসারে, দশম সংসদের ২২৬ জন অর্থাত্ ৬৫ শতাংশ এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯৪ জন এমপি অর্থাত্ ৭১ শতাংশই কোটিপতি। জাতীয় পার্টির ১৮ জন বা ৪৫ শতাংশ এমপির কোটি টাকার ওপরে সম্পদ রয়েছে। জাসদের ৬ জন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির একজন এমপি কোটিপতি। তরিকত ফেডারেশনের দুই এমপির দু’জনই কোটিপতি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে ৮ জন কোটিপতি। সম্পদের বাইরে আয়ের বিবেচনায় ৫৫ জন এমপির বার্ষিক আয় কোটি টাকার ওপরে বলে জানিয়েছিল সুজন।
রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ও অব্যাহত আছে। এ কারণেই রাজনীতি এখন কোটিপতি ও ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গেছে। অনেকেই রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন। অর্থলিপ্সার এ সুযোগে তৈরি হচ্ছে গডফাদার, টেন্ডারবাজ ও সুবিধাভোগী নেতা। রাজনীতিতে সম্পদশালীদের এ ব্যাপক অনুপ্রবেশের কারণেই গণতন্ত্রের মূল চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এমপিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় নির্বাচন এখন আর টাকা ছাড়া হয় না। তাই এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সময়ই প্রার্থীর অর্থ-প্রতিপত্তির বিষয়টি দেখে মনোনয়ন দেয়া হয়। কারণ নির্বাচনে জয়ের জন্য এখন টাকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আবার দলীয় কর্মকাণ্ডের জন্যও টাকা প্রয়োজন। যে কারণে ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিপত্তি আছে এমন লোকজনই এমপি হচ্ছেন। এটা তো দোষের কিছু নয়।
এমপিদের এ যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, কোটিপতি ব্যবসায়ীরা এমপি হয়ে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণে ক্ষমতাকে ব্যবহার করছেন। সাংবিধানিকভাবে এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে কারো কোনো বাধা নেই। এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও কোটিপতিরা। রাজনীতিকদের পিঠে বন্দুক রেখে তারা এমপি হয়ে সংসদে ঢুকে পড়ছেন। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি যখন ব্যবসায় জড়িত থাকেন তখন জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ একজন এমপি যে কিনা ব্যবসায়ীও তিনি জনগণের স্বার্থের চেয়ে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন। তখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের বণ্টন যথাযথভাবে হয় না। -manobkantha
পাঠকের মতামত