প্রকাশিত: ০৬/০৮/২০১৭ ১০:১৪ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:৩৬ পিএম
আবিষ্কারটি আসলে বাংলাদেশের ডাঃ সায়েবা আকতারের। ছবি: সংগৃহীত

আবিষ্কারটি আসলে বাংলাদেশের ডাঃ সায়েবা আকতারের। ছবি: সংগৃহীত
(প্রিয়.কম) সম্প্রতি প্রথম আলোতে একটি সংবাদ পড়েছেন অনেকেই। “কনডম বাঁচাতে পারে লাখো মায়ের জীবন!” এতে জানানো হয় কেনিয়ার ইউবিটি কিট নামের একটি উদ্ভাবনের কথা যাতে কনডম ব্যবহার করে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর একজন মায়ের বিপজ্জনক রক্তক্ষরণ কমানো যায় সহজেই। একই সংবাদ বিবিসিতেও অনেকে দেখেছেন হয়তো। আমরা ভাবছি তা হয়তো কেনিয়ার ডাক্তারদের উদ্ভাবন। আসলে কিন্তু এই উদ্ভাবনটি আসলে বাংলাদেশি একজন ডাক্তারের, যার নাম ডাঃ সায়েবা আকতার। এ ব্যাপারে মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ উপজিলা হেলথ কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ নাজিরুম মুবিনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায় নিম্নোক্ত তথ্যগুলো-

সায়েবা’স মেথড এবং মিডিয়ার অন্ধত্ব; বাংলাদেশি ডাক্তারের কৃতিত্বের ভাগিদার যখন অন্য কেউ

১) জহুরা। স্বামী পরিত্যক্তা। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। জহুরাকে বাঁচাতে গিয়ে ডাক্তাররা তার জরায়ু কেটে ফেলেছিল। বাচ্চাটাও আঁতুড়ঘরে মারা যায়। জহুরার জরায়ু নেই। সে আর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। স্বামী তাকে বাপের বাড়ি রেখে আসে। আর নিতে আসেনি।

২) ফাতেমা। সে বড়ই একা। তার মা নেই। ভাই-বোন নেই। সৎ মায়ের সংসারে থাকে সে। তাকে সবাই অলক্ষ্মী বলে ডাকে। কারণ ফাতেমার জন্মের সময় তার মা মারা যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে।

কেউ কি খেয়াল করেছেন আমাদের চারপাশে জহুরা, ফাতেমাদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে?
৩০-৪০ বছর আগেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রসব পরবর্তী রক্তপাত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় পোস্ট পারটাম হেমোরেজ বা পিপিএইচ। পিপিএইচের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশের জনগণের জন্য যা বহন করা সম্ভব ছিল না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত মায়েরা সন্তান জন্মদানের সময় মারা যেত। মৃত মায়ের সন্তানরাও বেশিদিন বাঁচত না। কখনো কখনো মাকে বাঁচাতে গিয়ে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হতো। সেক্ষেত্রে ওই মহিলা চিরদিনের জন্য মা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।

এই চিত্রটি ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েবা আকতার (Sayeba Akhter) ম্যাডামকে খুব ভাবিয়েছিল। ম্যাডাম পিপিএইচের জন্য স্বল্প খরচে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজছিলেন। রক্তপাত বন্ধের প্রধান উপায় হলো প্রেশার বা চাপ দেয়া। কোন ভাবে জরায়ুর ভেতরে কোন কিছু দিয়ে চাপ দিলে হয়তোবা রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু চাইলেই তো যেকোন বস্তু মানবদেহের ভেতরে প্রবেশ করানো যায় না। স্টেরিলিটির ব্যাপার আছে। মেডিকেল ইথিক্সের ব্যাপার আছে।

হঠাৎ ম্যাডামের মনে হলো বাচ্চারা তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর ফ্রি কনডম দিয়ে বেলুন বানিয়ে খেলে। কনডম একটা এফডিএ অনুমোদিত মেডিকেল ডিভাইস। ম্যাডাম কনডমের ভিতরে পানি ঢুকিয়ে এর স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষা করলেন। এটা জরায়ুর ভেতরে প্রবেশ করিয়ে যদি পানি দেয়া যায় তাহলে একসময় সেটা জরায়ুর দেয়ালে চাপ দিবে ফলে রক্তপাত বন্ধ হবে। ম্যাডাম পরের দিন সকালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখেন একজন মহিলাকে টোটাল হিস্টেরেকটমির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। অর্থাৎ তার জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হবে। কারণ তার প্রসব পরবর্তী রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। ম্যাডাম তখন প্রথমবারের মতো কনডম টেম্পোনেড ব্যবহার করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে ১৫ মিনিটের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়েছিল। রোগিটি তার জরায়ুসহ সুস্থভাবে বাড়ি ফিরেছিল।

২০০১-২০০২ সাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অধ্যাপক ডা. সায়েবা আকতারের নেতৃত্বে ২৩ জন রোগিকে এই চিকিৎসা দেয়া হয় এবং তাদের প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন।
২০০৩ সালে ম্যাডামের এই আবিষ্কার ও গবেষণা কর্মটি মেডস্কেপ মেডিকেল জার্নালে “Use of condom in the control of massive postpartum hemorrhage. Medscape General Medicine 2003; 5(3): 38. শিরোনামে প্রথম পাবলিশ হয়। পরবর্তীতে এটি অরিজিনাল রিসার্চ পেপার হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনি অ্যান্ড অবসেও পাবলিশ হয়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবে পাবলিশ হয়। বিশ্বজুড়ে এটি সায়েবা’স মেথড হিসেবে পরিচিতি পায়।আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিশ হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় সায়েবা’স মেথড সম্পর্কে তাদের দেশের ডাক্তারদের প্রশিক্ষিত করার জন্য। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ম্যাডামের এই মেথড নিয়ে এফসিপিএস ডিজার্টেশন, এমএস থিসিস, পিএইচডি থিসিস হয়েছে। ম্যাডামকে রয়্যাল কলেজ অব অবস অ্যান্ড গাইনোকলজিস্ট থেকে অনারারি ফেলোশিপও দেয়া হয়েছে।

গত ২ তারিখ বিবিসি একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় অ্যানি মুঞ্জেলা নামে কেনিয়ার একজন মিডওয়াইফ কনডম দিয়ে প্রসব পরবর্তী রক্তপাত বন্ধ করছেন। তিনি তার ক্লিনিকে এই পদ্ধতিতে ৬ জন মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে অনুন্নত দেশগুলোর আরো অনেক মায়ের জীবন বাঁচবে বলে আশা করা হয়। দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন বিবিসির ডকুমেন্টারিটা শুধু বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে। কেনিয়ার একজন মিডওয়াইফের নতুন আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতির খবর দেশবাসীকে জানায়। ৬ জন মায়ের জীবন বাঁচানোকে বাহাবা দেয়। অথচ এটা যে একজন বাংলাদেশি ডাক্তারেরই আবিষ্কার। শুধু ৬ জন না গত ১৭ বছরে সারাবিশ্বজুড়ে লক্ষাধিক মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে এই পদ্ধতি সেটা দেশের মানুষের অজানাই রয়ে গেলো।

আমাদের দেশের ডাক্তারদের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে মিডিয়ার বড়ই অনীহা। তারা অসৎ ডাক্তারদের খোঁজে ব্যস্ত। আমাদের এই সমাজ সামগ্রিকভাবে অসৎ প্রবণ। ডাক্তাররা এই সমাজের বাইরে না সুতরাং তাদের শতভাগ সৎ হবে এমনটা আশা করা কল্পনা বিলাস ছাড়া কিছু না। যমুনা টেলিভিশন বিএসএমএমইউতে ৫০ জনেরও অধিক চিকিতসককে ভূয়া ওষুধ লেখার অফার দেয়ার পর ১ জন চিকিৎসককে রাজি করাতে পেরেছিল। আচ্ছা ৫০ জন সচিবকে যদি এরকম কোন অনৈতিক অফার দেয়া হয় এদের মধ্যে ১ জনও কি পাওয়া যাবে না? ৫০ জন আইনজীবী? ৫০জন পুলিশের এসপি? ৫০জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? ৫০ জন ব্যবসায়ী? ৫০ জন এমপি? আমি নিশ্চিত এদের প্রত্যেক গ্রুপে ১ জনের অনেক বেশি অসৎ মানুষ পাওয়া যাবে। তাহলে কেন শুধু ডাক্তারের পিছনে লেগে থাকা?

ভালো খারাপ সব পেশাতেই আছে। তাই ইতিবাচক খবর প্রকাশ ও নেতিবাচক খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। নেতিবাচক খবরের পরিমাণ বেড়ে গেলে সেই পেশাজীবীদের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়। যেমনটা আমরা এখন ডাক্তারদের ক্ষেত্রে দেখছি।

মেডিকেল বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বা সরকারের এরকম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। উনারা যখন বক্তব্য দেয়া শুরু করেন তখন আগত সাংবাদিকরা উনাদের কিছু স্লিপ পেপার পাঠায়। যাতে লেখা থাকে বিরোধী দলের আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলুন। মন্ত্রী মহোদয় বক্তব্যের একদম শেষে বলেন, “আন্দোলনের নামে বিরোধী দলের জ্বালাও পোড়াও বরদাশত করা হবে না।” কিছুক্ষণ পরে টিভি স্ক্রলে বা পরের দিন পত্রিকায় ওই বরদাশতের খবরই প্রকাশ পায়। ওই একই কনফারেন্সে সায়েবা’স মেথডের মতো নতুন কোন মেথড দিয়ে কত লক্ষ প্রাণ বাঁচানো গেল সেটার তথ্যগুলো আর প্রকাশ পায় না। তাদের জন্য তাই বিবিসিই ভরসা। কেনিয়ার নিউজই অনেক।

বিবিসির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ডাঃ সায়েবা আকতারের বক্তব্য দেখুন এই ভিডিওতে-

পাঠকের মতামত