প্রকাশিত: ১২/০৩/২০১৭ ১০:৩৫ এএম

নিউজ ডেস্ক::

সড়কপথে নানা প্রতিবন্ধকতায় আকাশপথে ইয়াবা ট্যাবলেট বহন করছে চোরাচালানিচক্র। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে ইয়ারা সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশের পর কক্সবাজার থেকে সরাসরি চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপদে ইয়াবা বহনে ব্যবহার হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিমান। এমনকি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হেলিকপ্টার পর্যন্ত। বিমানবন্দর ও হেলিপ্যাডের দুর্বল তল্লাশি কার্যক্রম বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের কারণে নির্বিঘেœ ছড়িয়ে পড়ছে ঘাতক এ ট্যাবলেট। জলপথে প্রশাসনের তেমন কোনো টহল না থাকায় মিয়ানমার থেকে সাগরপথেও সরাসরি নদীতীরবর্তী জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ঢুকে পড়ছে ইয়াবার চালান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবা চালানের প্রতিটি ধাপে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সিন্ডিকেট, প্রশাসন ও সেকেলে মাদক ব্যবসায়ীরা জড়িত। সড়কপথে বিভিন্ন সংস্থা আলাদাভাবে তৎপর থাকায় অনেক সময় ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। ফলে বিকল্প হিসেবে আকাশপথ ও সাগরপথকে বেছে নিয়েছে চোরাচালানিচক্র। বিশেষ করে বেসরকারি হেলিকপ্টার ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়ায় নাটক, সিনেমার শুটিংসহ নানা ধরনের কর্মসূচির আড়ালে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডমেস্টিক (অভ্যন্তরীণ) টার্মিনালে ৮ হাজার ৫০ পিস ইয়াবাসহ জিল্লুর রহমান নামে একজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একটি বেসরকারি বিমানযোগে ওই চালান চট্টগ্রাম থেকে আসে। আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, মাদকের চালানটির গন্তব্য ছিল গাজীপুর। অন্যদিকে গত ৩ মার্চ ভোলা বোরহানউদ্দিনের একটি গ্রামে ৭৫ পিস ইয়াবাসহ এক যুবককে আটক করে পুলিশ।

বোরহানউদ্দিন থানার ওসি অসীম কুমার সিকদার আমাদের সময়কে বলেন, আটক জিল্লুর রহমানের বাড়ি চট্টগ্রামে। সে গত এক থেকে দেড় বছর বোরহানউদ্দিনে বসবাস করে নৌপথে ইয়াবার চালান এনে বিভিন্নভাবে বিক্রি করে আসছিল। তদন্তে আমরা তার শেকড় ধরার চেষ্টা করছি।

বিজিবি ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের (কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল) প্রধান লে. কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ বলেন, বিজিবি টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার বড় বড় চালান আটক করায় চোরাকারবারিরা স্থলপথকে নিরাপদ মনে করছে না। এসব কারণে চোরাকারবারিরা ইয়াবা পাচারের রুট বদল করে সাগরপথকে বেছে নিয়েছে।

পুলিশ বলছে, ভোলার মতো নদীতীরবর্তী প্রতিটি জেলা চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান ঢুকে পড়ছে। একসময় যারা হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রি করত, তারা এখন ইয়াবা ব্যবসায় নিয়োজিত। পাইকারি চোরাচালানিদের নিজস্ব ডিলাররা জেলায়-জেলায় সরবরাহ করছে। আর এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের একটি অংশ। এ কারণে পুলিশ অনেক সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের পরিচয় ও কর্মকা- জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছে না।

সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে সাত কোম্পানির ১৭টি হেলিকপ্টার রয়েছে, যারা ভাড়ায় ফ্লাইট পরিচালনা করছে। হেলিকপ্টার ফ্লাই করার কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা আগে বেবিচকের অনুমতি নেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ হেলিকপ্টার কোম্পানি সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে ‘ব্ল্যাংক প্যাড’ দিয়ে রেখেছে। ফ্লাইটের পরেই তারা এগুলো সমন্বয় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো. নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, যেসব রুটে কড়াকড়ি থাকে, চোরাচালানকারীরা সেসব রুট পরিবর্তন করছে। তারা নিত্যনতুন রুট খুঁজে বেড়ায়। মাদক চোরাচালানের নতুন রুট হিসেবে আকাশপথ বেছে নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি চালান আটকও হয়েছে। নদীপথেও মাদক পাচারের তথ্য আসছে। জনবল সংকট থাকায় মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের পক্ষে এতকিছু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে বিমানবন্দরগুলোয় অনেক সংস্থা কাজ করায় এ রুটে মাদক বহন কঠিনতর হবে বলেও আশাবাদী তিনি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ভারত-মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন নদী ও স্থলপথের ৬১২টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক দেশে ঢুকছে। চোরাপথে আসা এসব মাদকের কালো থাবা পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। কক্সবাজার সীমান্ত হয়ে মিয়ানমার থেকে ৪৫টি রুট দিয়ে ইয়াবা আসছে। এ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা ১২০০ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে। ওই তালিকায় কক্সবাজারের সরকারি দলের এমপি আব্দুর রহমান বদি, তার আপন দুই ভাই ও দুই সৎভাইয়ের নামও রয়েছে। কিন্তু তালিকা ধরে এখনো উল্লেখযোগ্য কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। বরং তালিকা ধরে ধরে প্রশাসনের উৎকোচ গ্রহণের হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, দিনাজপুরের হিলি, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, নওগাঁর সাপাহার ও নীলফামারীর হাতিবান্ধা হয়ে ইয়াবার চালান আসছে।

অভিযোগ রয়েছেÑ পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী একই ছায়াতলে থেকে মাদক ব্যবসা থেকে মাসোহারা গ্রহণ করছে। প্রশাসনের লোক জড়িত থাকায় অধিকাংশ ইয়াবার চালান নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। অনেক সময় প্রশাসনের লোকজন ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকবাণিজ্য দেখেও না দেখার ভান করছে।

অভিযোগ আছে, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের পরিদর্শক ও উপপরিদর্শকদের একটি অংশ বছরের পর বছর ধরে ঘুরে-ফিরে একই এলাকায় কর্মরত থাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে উঠেছে। বনিবনা না হলেই ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির বদলে অনেক সময় পুরস্কৃত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, রমনা জোনসহ রাজধানীর রমনা এলাকায় একটানা ১০ বছরের মতো দায়িত্ব পালন করে আসছেন মাদকদ্রব্যের পরিদর্শক আব্দুল আজিজ। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগে পরিদর্শক হুমায়ন কবীরের বিরুদ্ধে কয়েকবার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু ওপরের ইশারায় সব শাস্তি মওকুফ করে তাকে নোয়াখালীতে বদলি করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরে এমন কর্মকর্তা বহু রয়েছেন। অথচ গত ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২৭ বছরে এ পর্যন্ত ৩০ মহাপরিচালক বদলি হয়েছেন। পরিচালক (অপারেশন) পদে একই সময়ে ২৩ জন বদলি হয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাপরিচালক ও পরিচালকদের বাইরে থেকে প্রেষণে নিয়োগ করায় তারা যত দ্রুত সম্ভব বদলির চেষ্টায় থাকেন। কর্মকর্তাদের দ্রুত বদলি হওয়ায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের কাছে জিম্মি থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তৎপর ছিল ঘুরে-ফিরে রাজধানীতে পোস্টিং পাওয়া সংঘবদ্ধ চক্র।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় থাকলে তার কর্তব্যবোধ থাকে না। তিনি কোনো না কোনোভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়তেও পারেন। আমরা এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে বদলি করছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, তাদের জনবল সংকটও রয়েছে। ২৩ জেলায় এখনো অফিস নেই। বিভাগীয় জনবল ৫০ থেকে আড়াইশতে উন্নীত করা হলেও তা অপ্রতুল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, অস্ত্র, মোবাইলে আড়িপাতার সক্ষমতা, ঝুঁকিভাতা, রেশন ও তদন্তভাতা নেই। উপপরিচালকের নিচের কর্মকর্তাদের যাতায়াতে গাড়ি নেই।

সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক থেকে নিচের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম (পোশাক) দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ব্যবহৃত ইউনিফর্মের রঙ এবং জুনিয়র-সিনিয়র বিভেদ তৈরির অভিযোগ এনে এখনো কেউ পোশাক পরছেন না। এ নিয়ে মাদকদ্রব্য পরিদর্শক থেকে শুরু করে নিম্ন সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ চলছে।

পাঠকের মতামত