প্রকাশিত: ২৩/০২/২০২০ ৯:৫৯ এএম

গ্রেপ্তার বাণিজ্য, মাদক দিয়ে হয়রানি, হুমকি-ধমকি, জমি দখলে সহযোগীতা, শারীরিক নির্যাতনসহ নানান অভিযোগ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কিছু উপ- পরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে। এই এসআইগণ বাহিনীটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও অভিযোগ । মাদক নির্মূলের আড়ালে অনিয়ম, আটক বাণিজ্য ও সাজানো মামলায় মিথ্যা আসামি করে ঘুষ আদায় করে রাতারাতি কোটি বনে গেছেন এসব এসআই । তাদের রোষানলে পড়ে মাদকের সাজানো মামলায় অনেকেই আজ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না তাদের কবল থেকে। এই এসআইদের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তাদের সাজানো মামলায় আসামি হয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন । সাধারণ মানুষকে মাদক দিয়ে চালান দেয়া এবং ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি রাজধানীর দারুসসালামে ডিবি পুলিশের এক উপপরিদর্শককে (এসআই) আটক করা হয়। মিরপুরের মাজার রোড এলাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের একটি পার্সেলে মাদকদ্রব্য পাওয়ার সূত্র ধরে তাঁকে আটক করা হয়। আটক এসআইয়ের নাম জলিল মাতাব্বর। তিনি নারায়ণগঞ্জের জেলা গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) কমর্রত ছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে গোপালগঞ্জে বদলি করা হয়। অভিযোগ সাধারণ মানুষজনকে ফাঁসানোর জন্যই মজুদ করেছিলেন মাদক, অস্ত্র ও গুলি। মো. আবদুল জলিল মাতব্বর নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে দীর্ঘদিন কমর্রত ছিলেন। সম্প্রতি সেখান থেকে তাকে বদলি করা হয় গোপালগঞ্জ সদর থানায়। সেখানে যোগ দিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির চালান সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানোর পর রাজধানীর দারুস সালাম থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ওইদিন রাতেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক দুলাল হোসেন বলেন, মাদকদ্রব্য আর গুলির উৎস ও গন্তব্য জানতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দারুস সালাম থানার আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নারায়ণগঞ্জ ডিবিতে কর্মরত থাকাকালে কাউকে গাঁজা, কাউকে ইয়াবা, কাউকে হেরোইন দিয়ে ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করার কথা স্বীকার করেছেন এসআই জলিল মাতব্বর। তিনি ‘মোটা অঙ্কের’ টাকার জন্য মাদকের সঙ্গে কখনো আগ্নেয়াস্ত্র, কখনো গুলি উদ্ধার দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে সর্বস্বান্ত করার কথাও স্বীকার করেছেন। জলিল মাতব্বরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন অভিযানে উদ্ধার বিভিন্ন মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও গুলি আলামত হিসেবে না দেখিয়ে নিজের কাছে রেখে তা চড়াদামে অপরাধীর কাছে বিক্রি করার তথ্যও পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দারুস সালাম থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ ডিবিতে চাকুরিকালে তিনি যা করেছেন তার কিছু কিছু তথ্য দিয়েছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে মামলা করা হয়েছে। পুলিশের মিরপুর জোনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো এসআই জলিলের মালামালের পার্সেল থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জ ডিবিতে কর্মরত থাকাকালে তিনি এসব অবৈধ মালামাল দিয়ে বিভিন্ন মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করতেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, বাগেরহাটের বাসিন্দা জলিল মাতব্বর ১৯৯৮ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। তারপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি নারায়ণগঞ্জে ডিবি কার্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় গোপালগঞ্জে বদলি হন। মামলার বিবরণীতে দারুস সালাম থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) দুলাল হোসেন জানান, দক্ষিণ কল্যাণপুরস্থ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস অফিসের মূল ভবনে কুরিয়ারের মালামাল রাখার খালি জায়গায় মদের গন্ধ বের হচ্ছে এবং সেখানে বিয়ার, ইয়াবা ও গুলি দেখা যাচ্ছে মর্মে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মচারীরা পুলিশকে অবহিত করেন। খবর পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে একটি ফাইল ক্যাবিনেট ও ট্রাংক খুলে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার মূলে জব্দ করি।

সব মিলিয়ে ৬৩ রকম মালামাল উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে একটি পুরাতন পিস্তল, একটি খেলনা পিস্তল, বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের ৫২টি গুলি ও ৪০টি কার্তুজ, ১১টি বিয়ার ক্যান, স্বর্ণের সাড়ে ৩৬ গ্রাম ওজনের গলার সীতা হার, গলার চিক, একটি ব্রেসলেট, একজোড়া কানের ঝাপটা, এক জোড়া কানের ঝুমকা, দুটি স্বর্ণের নাকফুল, সাদা পলিথিনে মোড়ানো দুই প্যাকেট লুজ গাঁজা, সবুজ পলিথিনে মোড়ানো ১৩ পুরিয়া হেরোইন, সাদা পলিথিনে মোড়ানো এক পুরিয়া হেরোইন, সব মিলিয়ে যার ওজন প্রায় ৪০.৭৫ গ্রাম। এছাড়া ৫২৮৯টি ইয়াবা, ইয়াবার মতো দেখতে আরও ২ হাজার ৩০৭ পিস ট্যাবলেট, ৪টি চাকু, ২টি হাতুড়ি, একটি প্লাস, একটি টর্চলাইট, বিভিন্ন কোম্পানির ৩০টি মোবাইল ফোন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবের কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিবিতে এসআই মো. আবদুল জলিল মাতব্বরের মত আরো অনেক এসআই আছেন যারা এসব করেন। গ্রেপ্তার বাণিজ্য, মাদক দিয়ে নিরীহদের হয়রানি, নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়া, মাদক কারবারিদের সাথে সখ্যতা, রাজনৈতিক সখ্যতা, দালালদের যোগসাজশে জমি দখল, গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে থানা বা অন্য জায়গায় এনে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া, মাদক, জুয়া, চোরাচালান ইত্যাদি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় যুক্ত করার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এসব এসআই। এসব এসআইদের কারণে গোটা পুলিশ বাহিনীর সুনামের জন্য বিড়ম্বনা ডেকে আনছে। তাদের অসঙ্গত আচরণে ডিবি পুলিশ সম্পর্কে জনমনে গড়ে উঠছে নেতিবাচক ধারণা। ডিবি পুলিশের এসব এসআই ঘুরেফিরে একইস্থানে চাকরি করে আসছেন। বদলির আদেশ হলেই রাজনৈতিক তদবিরে ফিরে আসছেন পুরনো স্থানে। আর একই জায়গায় থাকার কারনেও তারা গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বেশি দিন একই জায়গায় থাকার সুবাদে অসাধুচক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এই এসআইগণ অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রভাব খাটিয়ে একই জায়গায় দীর্ঘদিন থাকার মূল উদ্দেশ্যই হলো অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে কমপক্ষে তিনশত এসআইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সএ অভিযোগ জমা আছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে একীভূত করার প্রস্তাব ঢাকার প্রত্যাখ্যান

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসবাসে সব ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। একইসাথে ...