প্রকাশিত: ২০/০১/২০১৭ ৬:১৯ পিএম

বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা। রাতভর ডিউটিতে ক্লান্ত বাড্ডা থানার এসআই মিজানুর রহমান (২)। সাধারণ ডায়েরি, মামলা দায়েরের নথিসহ কাগজপত্র গুছিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন পরবর্তী অফিসারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। রাতজাগা ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারেই এলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ নারীকণ্ঠের চিৎকারে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কেটে যায় এসআই মিজানের। চোখ মেলেই দেখতে পান মধ্যবয়সী এক নারীকে। চোখে-মুখে তার প্রচণ্ড ক্রোধের ছাপ। চিৎকার করে ওই নারী বলছেন, ‘স্যার আমি স্বামীরে খুন করছি, আমারে দ্রুত ফাঁসি দেন।’ শাড়ি পরিহিত চল্লিশোর্ধ্ব ওই নারীর এক হাতে পলিথিনে মোড়ানো মাংসপিণ্ডজাতীয় কিছু, যা থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। ওই নারীর চিৎকারে হতচকিত ডিউটি অফিসার এসআই মিজান। কী করবেন প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না।

ততক্ষণে থানার সেন্ট্রিপোস্টে ডিউটিতে থাকা কয়েকজন কনস্টেবল হাজির হন ডিউটি অফিসারের সামনে। তাদের সহায়তায় কিছুটা শান্ত করার পর ওই নারী জানান, তিনি তার স্বামী ফজল আলী শেখকে (৫০) খুন করেছেন। স্বামীর রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে বাড্ডার আদর্শনগরের বাসায়। খুন করার পর স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে একটি পলিথিনে ভরে তিনি নিজেই হাজির হয়েছেন থানায়। ডিউটি অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে ফোনে ওসিকে বিষয়টি জানান। ওসির নির্দেশ পেয়ে ওই নারীকে নেয়া হয় হাজতখানায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই থানায় ছুটে আসেন বাড্ডা থানার ওসি আবদুল জলিল। থানার একটি টিমকে লাশ উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে ওই নারীর কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চান তিনি। বাড্ডা থানায় বৃহস্পতিবারের ওই দৃশ্যটি ছিল অনেকটা সিনেম্যাটিক।

এদিকে ঘটনা জানার পর যুগান্তর প্রতিবেদক দ্রুত উপস্থিত হন বাড্ডা থানায়। সেখানে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় স্বামী হন্তাকারী স্ত্রী চন্দ্রবাহারের। ততক্ষণে চোখে-মুখে ক্রোধের ছাপ কিছুটা ফিকে হয়ে ভিন্ন ভাবনা ভর করেছে। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে চন্দ্রবাহার যুগান্তরকে বলেন, পোতা (শিল-পাটা) দিয়ে মাথায় আঘাত করে তিনি নিজ হাতেই স্বামীকে খুন করেছেন। খুনের কারণ জানতে চাইলে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। দু’চোখ দিয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছরের সংসার ছিল আমাদের। আমাকে বিয়ের ৪-৫ বছরের মাথায় রুমি নামে আরেক মেয়েকে বিয়ে করেন আমার স্বামী। এতেও আমি বাধা দিইনি। স্বামী ও সতীনকে নিয়ে এক সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজি হননি স্বামী ফজল আলী। যিনি পেশায় রিকশাচালক।’ চন্দ্রবাহার বলেন, ‘এখানেই শেষ না ভাই, আগের দুটি বিয়ের কথা গোপন করে ৩-৪ বছর আগে শাবানা নামে আরেক মেয়েকে বিয়ে (তৃতীয়) করে সে। প্রায় বছর খানেক তারা একসঙ্গেও থাকেন। একাধিক বিয়ের কথা জানার পর ওই মহিলা রাগ করে ভারত চলে যান।’ তিনি বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছরের সংসার জীবনে তার চার ছেলেসন্তান রয়েছে। এর মধ্যে বড় ছেলে তারেক (২২) একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করে। পরেরজন কাওছার (২০) একটি ফলের দোকানে, তৃতীয় ছেলে রুহুল আমিন (১৮) চাকরি করে একটি চায়ের দোকানে আর ছোট ছেলে আলআমিন (১২) কিছুই করে না।

চন্দ্রবাহার বলতে থাকেন, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তার (চন্দ্রবাহার) পরিবারের লোকজন ফজল আলীর কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সে সময় সংসারে শুধু তার বড় ছেলে তারেক ছিল। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ওই চেষ্টায় বাধ সাধেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে বলেন, স্বামীকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম আমি। তাই পরিবারের সদস্যদের সাফ বলে দিই, একজন মেয়ের একবারই বিয়ে হয়। দ্বিতীয় কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না। যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন স্বামীকেই ভালবাসবেন।

যুগান্তর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি অঝরে কাঁদছিলেন। এক পর্যায়ে সামনে উপস্থিত বাড্ডা থানার ওসি আবদুল জলিলকে উদ্দেশ করে চন্দ্রবাহার বলতে থাকেন, ‘স্যার আমি খুন করেছি, আমারে ফাঁসি দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি আর একদিনও বাঁচতে চাই না’।

তাহলে স্বামীকে মারলেন কেন- এমন পশ্নের জবাবে চন্দ্রবাহার বলেন, ওর (স্বামীর) কাছে আমি জীবনে কিছুই চাইনি। শুধু বলেছিলাম, সপ্তাহে অন্তত একদিন যেন তিনি (স্বামী) এসে দেখা করে যান। তাতেই আমি সন্তুষ্ট থাকব। কিন্তু আমার এ ছোট্ট দাবিও তিনি (স্বামী) রাখেননি। পরে তিনি খবর পান, মধ্য বাড্ডার ৩৫৩ আদর্শনগরে একটি বস্তিতে তার স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী রুমিকে নিয়ে বসবাস করছেন। ওই ঘরেও আশরাফ (১২) ও মাহমুদা (৯) নামে দুই সন্তান রয়েছে। পরে তিনি সন্তানদের নিয়ে বাড্ডার আদর্শনগরে আবদুস সাত্তারের বস্তি এলাকায় একটি রুম ভাড়া নেন’।

চন্দ্রবাহার বলেন, স্বামী কখনও আমার ভরণ-পোষণ দিতেন না। সন্তানদের উপার্জনেই তার সংসার চলত। তিনি বলেন, একই বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়ার পর তিনি দূর থেকে মাঝে-মধ্যে স্বামীকে দেখতেন। চন্দ্রবাহার আরও বলেন, বুধবার দুপুরে তার সতিন রুমি দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যায়। এ খবর জানতে পেরে রাতের খাবার নিয়ে তিনি স্বামীর ওই বাসায় যান। কিন্তু খুশি হওয়ার পরিবর্তে তার স্বামী তাকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তা সত্ত্বেও অনুনয়-বিনয় করে তাকে রাতের খাবার খাওয়ান। পরে স্বামীর সঙ্গে রাতটা কাটানোর আবদার করেন চন্দ্রবাহার। কিন্তু তাতে রাজি না হয়ে উল্টো তিনি বলেন, ‘যা রাস্তায় বহু লোক আছে তাদের কাছে গিয়ে থাক।’ প্রিয় স্বামীর কাছ থেকে এ কথা শোনার পর তার মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জš§ নেয় বলে তিনি জানান। তারপরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এক বিছানায় না ঘুমানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে রাতভর স্বামীকে দেখবেন বলে আকুতি জানান। একথা বলতে বলতে ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, সারাটা জীবন যার জন্য অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিলাম সেই ব্যক্তি রাস্তায় গিয়ে অন্য লোকের সঙ্গে থাকার কথা বলায় আমার মাথায় রক্ত ওঠে যায়। চন্দ্রবাহার জানান, ঝগড়া-ঝাটির এক পর্যায়ে স্বামী ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি সারারাত ঘুমাননি। নানা কথা চিন্তার এক পর্যায়ে তিনি স্বামীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ভোরে ফজরের আজান দেয়ার পর তিনি নামাজ পড়েন। এরপর স্বামীকে হত্যার জন্য রান্নাঘর থেকে পুতা (শিল-পাটা) এনে তিন দফা মাথার কাছে গিয়েও ফিরে আসেন। পরে চতুর্থ দফায় পুতা দিয়ে ঘুমন্ত স্বামীর মাথায় একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লে রান্না ঘর থেকে বঁটি এনে স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে ফেলেন। এরপর অনেকটা পাগলের মতো একটি পলিথিন ব্যাগে গোপনাঙ্গটি নিয়ে তিনি সরাসরি থানায় চলে আসেন।

নির্মমভাবে খুন করার পর কেন এমন পৈশাচিক কাজ করলেন জানতে চাইলে চন্দ্রবাহার বলেন, ‘ও যদি ফের বেঁচে যায় তাহলে আরও অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করে দেবে। তাই ওটা কেটে ফেলেছি।’

জানা গেছে, ফজল আলী শেখের বাবা মৃত আবদুল ওহাব। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বরইমুড়িতে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। রাতে এ ঘটনায় চন্দ্রবাহারকে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে।

পাঠকের মতামত

আশ্রয় নেওয়া বিজিপিদের বিনিময়ে বাংলাদেশি বন্দি মুক্তি দেবে মিয়ানমার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) সদস্যদের ফেরানোর বদলে দেশটির জান্তা সরকারের কারাগারে থাকা ...