প্রকাশিত: ৩০/১০/২০১৯ ৯:৫২ এএম

বাংলাদেশ বিমানের যে ফ্লাইটটি আজ দিল্লি যাচ্ছে, তাতে থাকার কথা ছিল সাকিব আল হাসানের। ভারতের বিপক্ষে তার নেতৃত্বেই খেলার কথা ছিল দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। সেই সাকিবই আজ ক্রিকেটে নিষিদ্ধ। তার জীবনে নেমে এলো কালো অধ্যায়। ক্যারিয়ারে যোগ হলো একটি কালো স্পট। দেশসেরা এই ক্রিকেটারকে ছাড়াই তাই দিল্লি যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের টি২০ দলকে। অথচ গত শুক্রবার জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরুর আগেও সবাই জানত, সাকিবের নেতৃত্বেই ভারত সফর হবে। তখন কি আর জানা ছিল, কলঙ্কের দাগ নিয়ে খেলাটি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে সাকিবকে। অবশ্য মঙ্গলবার সাকিবের এই অধ্যায় প্রকাশ করে সমকাল।

এই অলরাউন্ডারকে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত সমকালের শঙ্কাই সত্যিই হলো। সব ধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন তিনি। গতকাল বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারকে শাস্তি দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।

এদিন সন্ধ্যায় আইসিসি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং একই বছর আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের ম্যাচের আগে ক্রিকেট জুয়াড়ির ফোন পেলেও তা আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন ইউনিট বা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দুর্নীতি দমন বিভাগকে জানাননি সাকিব। বিষয়টি ধরা পড়ে আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের তদন্তে। জুয়াড়ির কললিস্ট পর্যালোচনা করে তথ্য উদ্ধার করেন তারা। এ নিয়ে একাধিকবার আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের মুখোমুখি হতে হয়েছে সাকিবকে। তিনটি পৃথক ঘটনার জন্য দুই বছরের শাস্তি নির্ধারণ করে আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ট্রাইব্যুনাল। তবে শুনানিতে সাকিব নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করায় এবং ক্ষমা চাওয়ায় শাস্তি এক বছর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর আবার খেলায় ফিরতে পারবেন সাকিব।

আইসিসি জানিয়েছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলংকাকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ চলাকালে ক্রিকেট জুয়াড়ি যোগাযোগ করে দু’বার অনৈতিক প্রস্তাব দেয় সাকিবকে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সেই সিরিজে উপস্থিত আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটকে বিষয়টি অবহিত করেননি তিনি। বিসিবির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। একই বছর ২৬ এপ্রিল আইপিএল ম্যাচের আগেও জুয়াড়ির কাছ থেকে অনৈতিক প্রস্তাব পান সাকিব। এবারও ভুল করেন আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটকে না জানিয়ে। ফলে এ দুটি ঘটনাই অ্যান্টিকরাপশন ধারা ২.৪৪ ধারায় শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ক্রিকেটার জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে সেটা যত দ্রুত সম্ভব সংশ্নিষ্ট বিভাগকে জানাতে হবে। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। সাকিব তিন-তিনবার নিয়ম ভেঙেছেন তথ্য না দিয়ে। অথচ সেই ২০০৮ সালে জুয়াড়ির প্রস্তাব পেয়ে সেটা বিসিবিকে অডিও রেকর্ডসহ দিয়েছিলেন। এর দশ বছর পর পরিণত সাকিব কেন এই ভুল করলেন- সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আইসিসির নিয়ম আছে, যে কোনো সিরিজ বা টুর্নামেন্টের আগে অংশগ্রহণকারী ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, ম্যাচ অফিসিয়াল, গ্রাউন্ডস স্টাফসহ সংশ্নিষ্টদের জুয়াড়িদের ব্যাপারে সচেতন করা হয়। প্রতিটি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এ কারণে বিসিবিরও অ্যান্টিকরাপশন ইউনিট গড়ে তুলেছে। প্রতিটি ক্রিকেট ভেন্যুর ড্রেসিংরুমের সামনে এবং ভেতরে আইসিসির তালিকাভুক্ত সন্দেহভাজন জুয়াড়িদের ছবি এবং ফোন নম্বর দেওয়া থাকে। এ ছাড়াও কোনো অপরিচিত নম্বর থেকে, কোনো অপরিচিত ব্যক্তির ফোন পেলে তা দুর্নীতি দমন বিভাগকে জানাতে হবে। হোটেলে বা পথেঘাটে অপরিচিত কেউ উপহার সামগ্রী দিলে বা আপ্যায়ন করতে চাইলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটকে জানাতে হবে। এই নিয়মগুলো জানার পরও কেন সাকিব হেলা করলেন? বিষয়টিকে যে তিনি গুরুত্ব দেননি, সেটা আইসিসির তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে। আইসিসি জানিয়েছে, মোট তিনবার রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হয়। তবে কোনোভাবেই ম্যাচ বা স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি। সাকিবের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসির জেনারেল ম্যানেজার অ্যালেক্স মার্শাল বলেন, সাকিব আল হাসান খুবই অভিজ্ঞ একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। সে এ-সংক্রান্ত শিক্ষামূলক অনেকগুলো কোর্সে সে অংশ নিয়েছে। তার অবশ্যই প্রতিটি প্রস্তাব পাওয়ার পর জানানো উচিত ছিল।’

সাকিব অবশ্য নিজের ভুল স্বীকার করে আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন তদন্ত চলাকালীন সময়ে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘সাকিবের কাছ থেকেই আমি প্রথম শুনেছি গত বৃহস্পতিবার। আমি শাস্তির সময় বা মেয়াদ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এই ঘটনা শোনার পর খুব রাগ হয়েছিল। তার মতো একজন ক্রিকেটার কেন এটা জানাবে না। তবে একটা জিনিস ভালো করেছে, আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে সে।’

বিসিবি সভাপতি জানান, সাকিব বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার। ভারত সফরের সব পরিকল্পনাই তাকে ঘিরে করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি। যে কারণে জাতীয় দলের প্রস্তুতি ক্যাম্প শুরুর সময়েও অধিনায়ক হিসেবেই দেখা হয়েছে তাকে। পাপন বলেন, ‘আমি একটা কথা সব সময় বলেছি এবং বলি, অধিনায়ক মাশরাফির বিকল্প নেই। আর খেলোয়াড় সাকিবের বিকল্প হয় না। সে একাধারে দুজন ক্রিকেটারের দায়িত্ব পালন করে। ভারত সফরে তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে না।’ তবে সাকিবের যে কোনো প্রয়োজনে বিসিবি পাশে থাকবে বলেও ব্রিফিংয়ে জানান পাপন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, সাকিবকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে বিসিবি।

আইসিসির নিয়মে আছে, কোনো শাস্তি পাওয়া ক্রিকেটার আইসিসির নিয়ম মেনে অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলোতে অংশগ্রহণ করলে এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করলে শাস্তি আরও ছয় মাস কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিট থেকে এ রকম একটা প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমগুলোতে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন সাকিব, ‘বিশ্বের অধিকাংশ ক্রিকেটার ও সমর্থকের মতো আমিও চাই দুর্নীতিবিরোধী খেলার পরিবেশ। আমি আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের সঙ্গে এ ব্যাপারে কাজ করার অপেক্ষায় আছি। তরুণ ক্রিকেটারদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেব এবং নিশ্চিত করতে চাই, তরুণ ক্রিকেটাররা আমার ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।’

সাকিব দেশের প্রথম ক্রিকেটার যিনি কি-না জুয়াড়ির বিষয়ে সঠিক সময়ে রিপোর্ট না করে শাস্তি পেলেন। আর আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া দ্বিতীয় ক্রিকেটার তিনি। তার আগে বিপিএলে স্পট ফিক্সিং করে শাস্তি ভোগ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সাকিবের বিরুদ্ধে গত বছরের শুরু থেকেই তদন্তে নামে আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন ইউনিট। তদন্তের প্রতিটি ধাপে ধাপেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রায় এক বছর আগে প্রথমবারের মতো অ্যান্টিকরাপশন ইউনিটের মুখোমুখি হন সাকিব। বিষয়টি জানার পর থেকেই মানসিক যন্ত্রণায় ছিলেন। যদিও এই ঘটনা নিজের খুব কাছের মানুষকেও জানাননি তিনি।

পাঠকের মতামত