প্রকাশিত: ১১/০৫/২০১৭ ৭:৪৯ এএম
  • নাজমা আক্তার রোজী

নীল শাড়ির মেয়েটি! বড্ড দুঃখী। বাবা-মা, ভাইদের হারিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছিল। যে ছোট্ট ভাইটিকে খুব আদর করত, খুব ভালবাসত, যাকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিল, সেই নিষ্পাপ ছোট্ট ভাইটিকে পর্যন্ত বুলেটের আঘাতে জর্জরিত করেছে। নরম তুলতুলে শরীরটি নীরব-নিথর করে ফেলে রেখেছে মেঝেতে।

মেয়েটি জীবনে বাবার আদর-¯েœহ আর ভালবাসা পেয়েছে খুব কম। শাসন-বারণ তো ছিল স্বপ্নাতীত! স্বপ্ন ছিল বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার। বাবাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রচ- ইচ্ছে ছিল। ঢাকার রাস্তার দু’পাশের ফুটপাথ দিয়ে বাবার হাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। কখনও কখনও এটা কিনে দেয়ার, ওটা এনে দেয়ার বায়না ধরারও স্বপ্ন ছিল। ভাই-ভাবিদের নিয়ে ছুটে চলার ইচ্ছে ছিল। গল্প, কবিতা, ছড়ার শব্দগুলো মুখ থেকে যেন খই ফোটার মতন আবৃত্তি করার ইচ্ছে ছিল। ভাইদের সঙ্গে রাগ-অভিমান করে ভালবাসা বেশি পাওয়ার স্বপ্ন ছিল। ভাবিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে নিজেকে আকাশে উড়ানোর স্বপ্ন ছিল। ছোটকাল থেকেই লেখাপড়া আর রাজনীতির বাইরে নিজের আলাদা একটা পৃথিবী গড়ার ইচ্ছে ছিল। বাবা-মা, ভাই-ভাবি, বোন-দুলাভাই আর আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে স্বপ্নের তৈরি করার ইচ্ছে ছিল তার।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সে স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা দুমড়ে-মুচড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রতিটি বুলেটের আঘাতে আপনজনকে হত্যার করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বপ্নগুলোকেও হত্যা করেছে ঘাতকের দল। প্রতিটি আত্মীয়স্বজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে নিজের আশা-আকাক্সক্ষাও শেষ করে দিয়েছে। মেঝেতে পড়ে থাকা নিষ্পাপ ভাইটির নীরব-নিথর দেহটির মতোই নিজের ইচ্ছেগুলো নীরব-নিথর হয়ে গিয়েছে।

বিদেশের মাটিতে আদরের বোনটিকে নিয়ে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায় নীল শাড়ি পরা মেয়েটি। বোনটিকে রক্ষা করার জন্য বিদেশের মাটিতেও পালিয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। আজ এখানে রাত্রি যাপন করলেও কাল অন্য জায়গায় ঘুমানোর জায়গা খুঁজতে হয়েছে তাকে। দু’বোনের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁকে সর্বক্ষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। তখনও সে নিজের জীবনের কথা চিন্তা করেনি। নিজে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেনি।

আজ এখানে তো কাল সেখানে করে জীবন চলেছে দীর্ঘদিন। দিন-সপ্তাহ আর মাস-বছর শেষ হলেও বোন-সন্তানদের জীবনে নেমে আসা অদৃশ্য শত্রুর ভয় শেষ হয়নি। একটি রুমে রীতিমতো গাদাগাদি করেই ক্লান্তি ঘুমের রাত শেষ করতে হয়েছে। কখনও কখনও সবার সামনে ঘুমের ভান করে সজাগ থেকেছে। এই বুঝি শত্রুপক্ষ এসে হাজির! বোন-সন্তানদের বুকে বুলেট বিদ্ধ করে চলে যাচ্ছে! কাতরাচ্ছে সবাই…! মৃত্যুর যন্ত্রণা চোখে ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো প্রহরীর মতো টান টান করে পাহারা দিচ্ছে।

নীল শাড়ির মেয়েটি তার বাবার হাত ধরেই রাজনীতি শিখেছে। রাজার নীতি আর রাজনীতি তাঁর বাবাই যেন তাকে হাতে ধরে ধরে শিখিয়েছে। সেই দীক্ষা আর আদর্শ যখন মনে হতো, যখন বাবার সেই ৭ মার্চের বক্তব্য মনে পড়ত- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তখন নিজেকে আর অসহায় মনে করত না। বাবার দীপ্ত চলার নীতি যখন চোখে ভাসত, তখন নিজেকে আর একা মনে হতো না। বাবার নীতির সঙ্গে রাজনীতির আর রাজনীতির মাধ্যমে দেশ-জাতির ভাগ্য উন্নয়ন, ভাবতে ভাবতে তখন নিজেই ভেতরে ভেতরে একজন যোদ্ধা হয়ে উঠত।

২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বাবাকে বর্বর পাকিস্তান সরকার গ্রেফতারের পর বাবা তার জন্য কবর খোঁড়া দেখেও বলেছিলÑ ‘আমাকে হত্যা করো সমস্যা নেই, তবে আমার লাশটি আমার বাঙালীর কাছে পাঠিয়ে দিও’ কথাটি মনে পড়তেই নীল শাড়ি পরা মেয়েটি বাবার মতোই সাহসী হয়ে পড়ল! দুঃখ-কষ্ট আর নিজের স্বপ্নগুলোর কথা চিন্তা না করে জাতির স্বপ্নগুলোর কথা চিন্তা করতে শুরু করল। বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো নিজের একান্ত কাজ বলে মনে করল। অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে প্রথম বুলেট নিজের বুকে ধারণ করার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে-ময়দানে, মিছিলে-মিটিং-এ থাকার প্রত্যয় নিয়ে নিজের পরিকল্পনাগুলো নতুন করে সাজাতে শুরু করল।

১৯৮১ সালের ১৭ মে জন্মভূমিতে সেই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আবারও বাঙালী জাতিকে নিজের আত্মমর্যদা-সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার সংগ্রামের প্রথমভাগে নিজেকে বিলিয়ে দিল। যে স্বপ্ন দেখেছিল তার বাবা যে সংগ্রামের অগ্রভাগেও ছিল তার বাবা, সেই সংগ্রামে নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারেনি সমুদ্র পাড়ে নীল শাড়ির মেয়েটিও!

দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় নীল শাড়ির মেয়েটি। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর মেয়েটি বুঝতে পেরেছে দেশের নাম বাংলাদেশ আর পতাকার রং লাল-সবুজ থাকলেও এই দেশ আর ৩০ লাখ শহীদের দেশ নয়। আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় সংসদ থাকলেও এই দেশ আর ২ লাখ সম্ভ্রম হারানো নারী মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ নয়।

মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সম্প্রীতি, মানুষের সাংবিধানিক অধিকার এবং বাঙালী জাতির আত্মমর্যাদা নিশ্চিত করতে যদি নিজের প্রাণও চলে যায় তাও ভাল। বাবার কাছে গিয়ে বলতে পারবে- বাবা, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের পথে চলেছি। তারা যে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমি তাদের অধিকার নিশ্চিত করার পথে হেঁটেছি। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অর্থনৈতিক মুক্তির পথে সংগ্রাম করেছি। বাবা, আমি তোমার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা আর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশকে সাজাতে চেয়েছি!

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েও নীল শাড়ির মেয়েটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়নি। হতাশা তাকে ক্লান্ত করতে পারেনি। ভয়-ষড়যন্ত্র তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। কোন অশুভ রাস্তায় না হেঁটে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। মানুষও তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। চারপাশে তার জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা দেখে শত্রুপক্ষ অশুভ পথ বেছে নিয়েছে। কারণ তারাও একদা অশুভ রাস্তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল। তারা জনগণকে ভয় পায়। তাই মানুষকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। জনগণের নেতাকে তারা ধ্বংস করার অপকৌশল গ্রহণ করে। মানুষ-মানবতার নেত্রীকে তারা মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে নোংরা থাবা বসাতে চায়!

শেখ হাসিনা সাধারণের মাঝে অসাধারণ। মানুষের মাঝে অনন্য। নারীদের মাঝে আলোর প্রদীপ। তিনি খুব সহজেই সাধারণের মাঝে হারিয়ে যেতে পারেন। কখনও টেলিভিশন লাইভ অনুষ্ঠানে ফোন করে সঙ্গীতশিল্পীকে পছন্দের গানের অনুরোধ করে আবার কখনও নিজেই গুনগুনিয়ে গানের সুর তুলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়! কখনও ক্যামেরা হাতে নিয়ে নিজেই ছবি তুলে আবার কখনও রিক্সায়, ভ্যানে চড়ে অসাধারণ ব্যক্তি সাধারণের মাঝে হারিয়ে যায়! বাঙালী মা’র সেই চিরাচরিত আদর্শ তার সন্তানের জন্য নিজ হাতে রান্না করা শেখ হাসিনার সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য সবাইকে পুলকিত করেছে। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা আর অবসর সময়ে সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা করার একান্ত ছবিগুলো যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তখন অন্য মায়েরাও অনুসরণ করে, অনুকরণে নিজ সন্তানের জন্য স্বপ্ন দেখে।

শেখ হাসিনা শত-সহস্র মানুষের মাঝে সত্যিকার মানুষ, নেতা ও নেতৃত্ব। তার মনুষ্যত্ব আর মমত্ববোধ আমাদের নতুন প্রজন্মকে নতুন করে সত্যিকারের মানুষ হয়ে চলতে সহযোগিতা করে। তার আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। শেখ হাসিনাও তাঁর বাবার মতন রাজার নীতি নয়, জনগণের স্বপ্ন, নীতি-আদর্শের রাজনীতির মাধ্যমে তলাবিহনী রাজ্য থেকে বাংলাদেশকে আজ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ভিক্ষুকের জাতি থেকে সম্মান-শ্রদ্ধা করা জাতির উচ্চশির মর্যাদা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। এই দেশ ও জাতি শেখ হাসিনার হাতেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও গৌরবান্বিত মনে করে।

লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...