প্রকাশিত: ২৩/১২/২০২০ ১০:২১ এএম

রুমিন ফারহানা
গত ১৮ নভেম্বর চতুর্থবারের মতো জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সমালোচনা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ‘দ্য সিচুয়েশন অব হিউম্যান রাইটস অব দ্য রোহিঙ্গা মুসলিমস অ্যান্ড আদার মাইনরিটিজ ইন মিয়ানমার’ শিরোনামে এ প্রস্তাবে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের তীব্র সমালোচনা করা হয়। প্রস্তাবটি যৌথভাবে আনে আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। প্রস্তাবটি পাস হয় ১৩২ ভোটের সমর্থনে। ৯টি রাষ্ট্র বিরোধিতা করে এবং ৩১টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে।
বিপক্ষে ভোট দেওয়া ৯টি দেশের মধ্যে আছে চীন ও রাশিয়া। ভোট না দেওয়ার তালিকায় আছে জাপান, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালও। আর হ্যাঁ, ভারতও পরপর চতুর্থবারের মতো এমন প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানে বিরত থেকেছে। পক্ষে অনেক বেশি দেশ ভোট দিয়েছে; কিন্তু দুটি নাম এখানে একটু দেখে রাখা যাক- পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। তাহলে প্রশ্ন আসে- ভারত, জাপান কি আমাদের বন্ধু নয়? পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কি আমাদের অনেক বড় বন্ধু? তাহলে বিপক্ষে ভোট দেওয়া চীন কি আমাদের শত্রু?
দশকের পর দশক ধরে সারাবিশ্বের কূটনৈতিক মহলে সৌদি আরবের সবচেয়ে কাছের মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল পাকিস্তান। দুটি দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। পেট্রো ডলারে অতি ধনী এক দেশ আর তার সঙ্গে পারমাণবিক বোমার অধিকারী একমাত্র মুসলিম দেশটির শক্ত কৌশলগত সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল। পাস্ট টেন্সে বাক্যগুলো দেখে কারও মনে হতেই পারে- এই সম্পর্ক কি তবে শেষ হয়ে গেছে?

এ দুই দেশের বন্ধুত্ব আদতে কেমন ছিল, তার একটা চমৎকার উদাহরণ দেখা গিয়েছিল দুই বছর আগেই। সে সময় পাকিস্তান তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া নিয়ে খুব বড় বিপদে পড়ে। তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল সৌদি আরব। তারা তখন পাকিস্তানকে তিন বিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ এবং ঋণ হিসেবে আরও তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি তেল হ্রাসকৃত মূল্যে সরবরাহ করার নিশ্চয়তা দেয়।
দুই দেশের মধ্যে আলোচ্য ‘লেনদেন’ বা ‘বন্ধুত্ব’টি দুই বছর আগে যতটা আলোচিত হয়েছিল, গত কয়েক মাসে বৈশ্বিক পর্যায়ে সে তুলনায় অনেক বেশি সাড়া ফেলে দিয়েছে। কারণ, সৌদি আরব কয়েক মাস আগে থেকেই পাকিস্তানকে প্রচণ্ডভাবে চাপ দিচ্ছিল তার ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য, যেটা এ দুই দেশের লেনদেনের সম্পর্কের ইতিহাসে একেবারেই নজিরবিহীন। বিষয়টি সামাল দিতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান সৌদি আরব সফর করেন। তখন অনেককে অবাক করে সৌদির ‘ডি ফ্যাক্টো’ বাদশাহ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস বলে বেশি পরিচিত) পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখাই করেননি।
শেষ পর্যন্ত দেশ দুটির মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। তাই পাকিস্তানকে সৌদি আরব থেকে নেওয়া সেই ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পাকিস্তান গত জুলাই মাসে এ ঋণের প্রথম কিস্তি এক বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, আর কয়েক দিন আগে পরিশোধ করল আরও এক বিলিয়ন ডলার। আগামী মাসে শেষ কিস্তির টাকা পরিশোধ করার কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে, দশকের পর দশক টিকে থাকা সৌদি-পাকিস্তান ‘বন্ধুত্বে’ এই ফাটল কেন দেখা দিচ্ছে? ২০১৯ সালের আগস্টে ভারত তার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এগুলোকে ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। পাকিস্তান এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। পাকিস্তান চেয়েছিল, এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে বিশেষ সম্মেলন ডেকে প্রস্তাব পাস করুক ওআইসি। গত কয়েক বছরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অনেক উন্নতি হওয়া সৌদি আরব সেই পথে যায়নি। এটা পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে; পাকিস্তান সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখায়। পাকিস্তান এর পর মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ আরও কিছু মুসলিম দেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিকল্প সম্মেলন করে জম্মু-কাশ্মীরের ঘটনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে। এটা সৌদি আরবকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
দীর্ঘদিন থেকেই ফিসফাস ছিল, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপরে চাপ বাড়ছে। যারা মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি নিয়ে মোটামুটি ধারণা রাখেন, তারা জানেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে যেসব মুসলিম দেশ এগিয়ে গেছে, তাদের পেছনে খুব বড় ভূমিকা আছে সৌদি আরবের। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছিল ভীষণ কঠিন। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে পাকিস্তানের। দশকের পর দশক ধরে অটুট থাকা বন্ধুত্ব ভীষণ রকম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে গত এক বছরের মধ্যে।
সাম্প্রতিক পৃথিবীতে এ রকম আরও অনেক ঘটনা উলেল্গখ করা যায়, যেগুলো প্রমাণ করবে- দুটি দেশের সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ব বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আসলে নেই। যা আছে সেটি হলো পারস্পরিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের নিরিখে দেনা-পাওনার ওপর নির্ভর করা ভালো বা খারাপ সম্পর্ক। এ সম্পর্কের কারণেই কোনো দেশ তার স্বার্থের কিছু ছাড় অবশ্য দেয়, কিন্তু তারও সীমা আছে। আর সেই ছাড়ের বিনিময়ে সে কী পেতে পারে, সে হিসাবও করে কড়ায়-গণ্ডায়। প্রতিটি ছাড় দেওয়া হয় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো লাভের কথা মাথায় রেখে।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চীন সরকারের বেশ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা যদি অতীতের দিকে খেয়াল করি, তাহলে দেখব এই সুসম্পর্কের পথে কিন্তু খুব বড় কাঁটা থাকার কথা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় দেশটি ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে যখন তাইওয়ান সরকারকে বাদ দিয়ে ‘মেইনল্যান্ড চীন’ সরকারকে চীনের বৈধ সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় জাতিসংঘে, তখন ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে কমিউনিস্ট চীন প্রথম ভেটো দেয়। যে প্রস্তাবে তারা ভেটো দেয়, সেটি হচ্ছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি-সংক্রান্ত। সেদিক থেকে অন্তত বর্তমান সরকারের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সেটি হয়েছে, কারণ দুটি সরকারই তাদের পারস্পরিক স্বার্থ নিশ্চিত হবে বলেই মনে করেছে এ ক্ষেত্রে। কিন্তু এই ‘পরম বন্ধু’ চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে একাধিকবার। আর সাধারণ পরিষদে আনীত নিন্দা প্রস্তাবে চীন সব সময় ভোট দিয়েছে প্রস্তাবের বিপক্ষে। এতে কি প্রমাণিত হলো- বাংলাদেশের চাইতে মিয়ানমার চীনের কাছে বড় বন্ধু?
এই দফার রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির পর থেকে, বিশেষ করে গত দুই বছর ভারত বারবার আশ্বাস দিয়েছে, এ সংকটের ব্যাপারে তারা কাজ করবে। কিন্তু জাতিসংঘের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চারবার নিন্দা প্রস্তাবে ভারত প্রতিবারই ভোটদানে বিরত থেকেছে। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের দীর্ঘদিনের ‘বন্ধু’ জাপানের ক্ষেত্রেও। এ দুই দেশ যা করছে, আসলে সেটিই করার কথা।
আসল কারণ কি এই- বাংলাদেশ তার দরকষাকষি করার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়েছে? ২০১৪ সালের পর থেকে সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করার সময় কী নিয়ে দরকষাকষি করে, কী তার প্রায়োরিটি, সেটির যৌক্তিক অনুমান করা আদৌ কঠিন বিষয় নয়।
দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় বিষয় যে কোনো দেশকে তার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য দরকষাকষির ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশের এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। সেই যোগ্যতা অর্জন না করে বন্ধুত্বসহ আর যত বিশেষণই ব্যবহার করা হোক না কেন, সম্পর্কের ধরন বোঝাতে, সেটি একেবারেই মূল্যহীন, রোহিঙ্গাসহ আমাদের আরও অনেক দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান না হওয়াটাই সেটির জাজ্বল্যমান প্রমাণ।
সংসদ সদস্য; কলাম লেখক

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...