প্রকাশিত: ১৯/০৮/২০১৯ ৯:৪৯ এএম

নিউজ ডেস্ক::
কক্সবাজার থেকে আগামী ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে।আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। টেকনাফের কেরুণতলী ঘাট দিয়ে তালিকাভুক্ত ৩ হাজার ৫৪০ রোহিঙ্গাকে প্রথম পর্যায়ে মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে শুরু হতে পারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। এ জন্য শনিবার থেকে ওই ঘাট প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়েছে। প্রস্তুতি চলছে টেকনাফের নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা শিবিরেও।

রোববার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গঠিত টাস্কফোর্সের জরুরি বৈঠক হয়েছে কক্সবাজারে।বৈঠক শেষে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল আলম নেজামী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত।২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের যে কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে তা নিয়েও এ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

আর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ১৮ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেছেন, ‘আমরা চাই, নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও পূর্ণ অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক।তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের কাছে সব সময় একটি অগ্রাধিকার ইস্যু এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। যদি রোহিঙ্গারা ফিরে না যায়, তবে শুধু জমির অধিকার নয় তারা তাদের সব অধিকার হারাবে।

এ জন্য আগামী কয়েক সপ্তাহজুড়ে (নেক্সট কাপল অব উইক) কক্সবাজারের একাধিক শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য বোঝাব। তারা যদি মিয়ানমারে ফেরত না যায়, তবে ভূমিসহ তাদের কোনো অধিকারই তারা পাবে না।’

ওই সেমিনারে পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ‘যেকোনো সময়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে।’

এদিকে যাদের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এতদিন হচ্ছিল না,সেই ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষন করেছে বলে একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছে। সরকার এবং ইউএনএইচসিআর প্রথম প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌছেঁছে বলে জানা গেছে। মূলত ইউএনএইচসিআর রাজি হওয়ার কারণেই ২২ আগস্ট বা এর পরে ‘যেকোনো সময়ই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে।’

এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছর তৈরি করা টেকনাফের নাফ নদের সীমান্তে অবস্থিত কেরণতলী ঘাটটিতে আবারও সংস্কারের কাজ চলছে। ১৭ আগস্ট বিকালে প্রত্যাবাসন ঘাট পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। এসময় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি দলকেও প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থান ও কক্ষ ঘুরে দেখতে দেখা যায়।

প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বে থাকা প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি মোহাম্মদ শহীদুল হাসান জানান, এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কাজকর্ম চলছে।

প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বরত ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকদিন ধরে কাজ চলছে। তাদের আমরা সহযোগিতা করছি। শুনেছি, কয়েকদিনের মধ্যে এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে।’

অপরদিকে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সরকার তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার তালিকা গত ৮ আগস্ট জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) দিয়েছে। ওই রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরতে চায় কি না সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বাংলাদেশ সরকার ইউএনএইচসিআরকে অনুরোধ জানিয়েছে।

জানা গেছে, তিন হাজার ৪৫০ জনের তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের ফেরার বিষয়ে মতামত জানাতে ইউএনএইচসিআর অনুরোধ জানাচ্ছে। এ বিষয়ে ইউএনএইচসিআর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বক্তব্য নেবে। তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ফিরতে চায়, ইউএনএইচসিআর তাদের পরবর্তী করণীয় বিষয়ে জানাবে। প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত জানাবে। আর যারা ফিরতে চায় না তাদের বক্তব্য এবং ফিরতে না চাওয়ার কারণ ইউএনএইচসিআর লিপিবদ্ধ করবে। এরপর তারা নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যাবে।

ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা দিতে পারছে না। বিশেষ করে, রোহিঙ্গারা ফিরলে তাদের যে জায়গায় রাখার কথা সেসব জায়গায় ইউএনএইচসিআরের প্রবেশাধিকার নেই। তাই রোহিঙ্গাদের নিজস্ব উপায়ে তথ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইউএনএইচসিআর উৎসাহী করছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সন্ত্রাস ও চরমপন্থাবিরোধী ব্যুরোর (কাউন্টার টেরিরিজম ও কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম) উপসমন্বয়ক (ডেপুটি কোঅরডিনেটর) জন টি গডফ্রে এখন ঢাকা সফর করছেন।

তিনি রোববার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন।

জন টি গডফ্রে ও পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

জবাবে পররাষ্ট্র সচিব গডফ্রে’কে বলেন, ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। এ জন্য যা যা করণীয়, ঢাকার পক্ষ থেকে সবকিছুই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে।

একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২২ আগস্ট সত্যি সত্যি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে কি না— সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত না। কেননা, প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে এখনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেনি মিয়ানমার। আবার রোহিঙ্গারাও ফিরে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করছে না।

এছাড়া যে রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে ফেরত যাবে, তাদের বিষয়ে এখনো ভেরিফিকেশন রিপোর্ট (তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দেওয়া যে তারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়) দেয়নি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা।

মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জো এইচটে গত শুক্রবার (১৬ আগস্ট) নেপিডো’তে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে জানান, আগামী ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যবাসন শুরু করতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্মত হয়েছে। প্রথম ধাপে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে আনা হবে।

এদিকে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে গত ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে গত ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়।

রোহিঙ্গ সংকট সমাধানে নেপিডোর সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ‘৯ অক্টোবর ২০১৬ ও ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফেরত নিবে মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।’

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চুক্তি সইয়ের পর প্রায় দেড় বছর পার হলেও প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। উল্টো একাধিক অজুহাতে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছে মিয়ানমার। এর মধ্যে একবার রোহিঙ্গা প্রত্যবাসনের তারিখ ঠিকও হয়। তবে সেই প্রক্রিয়াও আলোর মুখ দেখেনি।

জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকার আন্তরিক নয় বলেও মত তাদের। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নির্যাতনকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। রাখাইন সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তুমুল সমালোচনা করছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, কুয়েত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পুরো বিশ্ব। তবে প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি স্বভূমে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার তারিখ নির্ধারণ করলেও শেষ সময়ে এসে বেঁকে বসে রোহিঙ্গারা।

নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কোনও প্রতিশ্রুতি না থাকা, নিজ গ্রামে ফিরে যেতে না দিয়ে বদ্ধ শিবিরে আটকে রাখার আশঙ্কা, নাগরিকত্ব না দেওয়া ইত্যাদি কারণে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাননি উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা। এ কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও শুরু করা যায়নি।

তবে সেসময়েই উখিয়ার ঘুমধুমের প্রত্যাবাসন ঘাটের পাশাপাশি টেকনাফের নাফ নদের তীরের এই কেরণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাটটি নির্মাণ হয়েছিল। এর মধ্যে টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাটে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি, ৩৩টি সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠকের মতামত

পুলিশ থেকে বাঁচতে জীবনটাই দিলেন সিএনজিচালক

গ্রামের চন্দনাইশে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে ...

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চলন্ত সিএনজিতে সিলিন্ডার বি’স্ফোরণ, চালক নিহত

চট্টগ্রাম – কক্সবাজার সড়কে চন্দনাইশ এলাকায় চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুনে দগ্ধ হয়ে ...