প্রকাশিত: ০৫/০৮/২০১৮ ১০:৩৭ পিএম , আপডেট: ১৬/০৮/২০১৮ ১১:৪৫ পিএম

নিউজ ডেস্ক::
রাখাইনের রোহিঙ্গা নিপীড়ন তদন্তে চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিশন। হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কমিশনের সদস্যরা এরইমধ্যে তদন্তকাজে নিয়োজিত হয়েছেন। তবে দুই বিদেশি কূটনীতিককে নিয়ে গঠিত ওই ‘স্বাধীন’ তদন্ত কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রত্যাখাত হয়েছে। তদন্ত কমিশনে থাকা দুই বিদেশি তদন্তকারীর অতীত ভূমিকা পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, তদন্তকাজে তাদের ভূমিকা মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকেই প্রতিফলিত করবে। তারা মনে করছেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে কূটনৈতিক সুনাম অর্জন করতেই কথিত ওই স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন সু চি।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশতে থাকে মৌসুমী বাতাসে। মানবাধিকার সংগঠনের স্যাটেলাইট ইমেজ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন আর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শূন্যে ছুড়তে থাকে সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। এমন বাস্তবতায় নিধনযজ্ঞের বলি হয়ে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।
মিয়ানমার বরাবর দাবি করে আসছে গত বছরের আগস্টে রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলে চালানো অভিযান ছিল বৈধ নিরাপত্তা অভিযান। সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের হামলার জবাবে এই অভিযান চালানো হয়েছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো এই অভিযানে ধারণা করা হয় এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিলেন। মানবাধিকার গ্রুপগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ হাইজর করলেও সু চির সরকার তা ‘ভুয়া খবর’ বলে অস্বীকার করে আসছিল। এছাড়া রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রমাণ উন্মোচন করায় সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ, জাতিসংঘের তদন্ত দলকে ওই এলাকায় প্রবেশে বাধা দিয়েছে এছাড়া মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদেরও দেশটিতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে কয়েকটি পশ্চিমা দেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মিয়ানমার সরকার। তবে তাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশি চীন মিয়ানমারকে দায়বদ্ধ করতে জাতিসংঘের আনা একটি প্রস্তাব আটকে দেয়। গত মে মাসে আন্তর্জাতিক চাপে সু চির সরকার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমারে ঢোকার অনুমতি দেয়। তাদের অনুরোধে আন্তর্জাতিক সদস্যদের নিয়ে স্বাধীন একটি তদন্ত কমিটি প্রতিশ্রুতি দেন সু চি। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ঘটনার প্রায় এক বছর পর অভিযোগ তদন্তে দুই বিদেশির সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এড়াতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি এই কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। মিয়ানমারের গঠিত ওই কমিশনে রয়েছেন ফিলিপাইনের সাবেক ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালাও, জাপানের সাবেক জাতিসংঘ দূত কেনজো ওসিমা, মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান উ মাইয়া থেইন ও অং তুন থেট। তারা রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারকে পরিচালিত করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিকে মানবাধিকার প্রশ্নের উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার অতীত নজির আছে কমিশনের সদস্য মানালাওয়ের। মানবাধিকারের সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে ক্ষুণ্ন করে দক্ষিণ এশীয় জাতিগুলোর জন্য একটি নিজস্ব কথিত মানবাধিকার চুক্তি বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টার অংশ ছিলেন তিনি। রবার্টসন মন্তব্য করেছেন, মানালাম হলেন সেই ব্যক্তি যাকে দিয়ে এই কমিশনের সম্ভাব্য ভূমিকাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব। তিনি মনে করেন, মানালাম মুখে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা বলেন আর সহিংসতার জন্য দায়ীদের আড়াল করার চেষ্টা করেন।
অং তুন থেটের বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে তিনি নিরপেক্ষও নন, এমনকি স্বাধীনও নন। এর আগে জাতিসংঘের তরফে তোলা রোহিঙ্গা নিপীড়নের অভিযোগ তদন্ত কমিটির অংশ হয়ে তিনি ২০১৬ সেই অভিযোগ প্রত্যাখান করেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে কাঠামোবদ্ধ নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিতেও অস্বীকার করেন তিনি। রবার্টসন তাকে সরকারপক্ষীয় আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, রোহিঙ্গা নিপীড়ন অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার যে ভাষ্য প্রচার করে থাকে, তার সমর্থন নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা নেবেন অং তুন থেট।
জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার এনজিও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব অব জ্যুরিস্টস’র কর্মকর্তা সিয়ান বিয়ান বলেন, ‘একটি কার্যকর তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা, জনবল ও অপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্ট আইনি বৈধতা থাকা দরকার।’ তবে এই কমিশন কোনও ম্যান্ডেট ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে। রাখাইনের অতীত তদন্তগুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাই দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে এই কমিশনের যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশা করা অমূলক। স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি ক্ষেত্রে, দোষীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপই কেবল বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা বলে মনে করেন মিয়ানভিত্তিক বিশ্লেষক রিচার্ড হরসেই। চলতি সপ্তাহে তিনি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের দিস উইক ইন এশিয়া বিভাগকে বলেন এসব কথা বলেন। তার ধারণা আন্তর্জাতিক বিচারে অভিযুক্তদের পাওয়া নাও যেতে পারে এমনকি মিয়ানমারও তাদের হম্তান্তর করতে অস্বীকার করতে পারে। তিনি বলেন, আগামী মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নিজের সক্রিয়তা দেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি (সু চি) বিশ্বকে দেখাতে যান সহিংসতার এক বছরের মাথায় অগ্রগতি হয়েছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন করা গেলে তা মিয়ানমারের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যেতে পারে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোর অভিযোগ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে কাঠামোগত ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে ছিল বিস্তৃত গণহত্যা, নিপীড়ন ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। তবে মিয়ানমারের সংবিধান অনুসারে দেশটির সেনা সদস্যরা বেসামরিকদের জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। শীর্ষ তিনটি মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে এছাড়া পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই এক চতুর্থাংশ আসনের নিয়ন্ত্রণও তাদের কাছে রয়েছে। ২০১৫ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর আশা করা হয়েছিল সু চি জেনারেলদের ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ আনবেন তবে তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রিচার্ড হরসেই বলেন, সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক খুবই নাজুক। সেকারণে পর্দার আড়ালের আলোচনার মধ্য দিয়ে এমন এক তদন্ত প্রক্রিয়া পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অবশ্যই সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই কমিশনে সাবেক একজন আন্তর্জাতিক সামরিক কর্মকর্তা না থাকা হতাশাজনক বলে মনে করেন ইয়াঙ্গুনের এক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক। তার মতে সেটা হলে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ থাকতো। তিনি বলেন, এমন তদন্ত কূটনীতিকদের কাজ নয়। ইয়াঙ্গুন সেন্টার ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিসার্চ-এর কর্মকর্তা সোয়ে মিয়ান্ট অং বলেন, এই কমিশন খুবই জটিল একটি জন সংযোগ প্রক্রিয়াকে সামনে এনেছে। তা হলো আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ আবেগের ওপর ভারসাম্য রক্ষা। মিয়ানমারের সরকারের মতো বেশিরভাগ নাগরিক রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে থাকে। দীর্ঘদিন সেই দেশে বসবাস করে আসলেও তারা মনে করে থাকে তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। রোহিঙ্গাদের জতিগত পরিচয়েরও স্বীকৃতি মেলে না।
সামরিক রাজনীতিবিদ ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা এই কমিশনের বিরোধীতা করেছে। তাদের অভিযোগ রাখাইনের জাতিগত বৌদ্ধদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক নজরদারি সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। এই কমিশনের পরিবর্তে সরকারের কাছে তারা সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের চালানো সহিংসতা তদন্তের দাবি তুলে থাকেন। সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সরকারের প্রথম মেয়াদের অর্ধেকেরও বেশি সময় এর মধ্যেই পার হয়েছে। আগামী নভেম্বরে একটি উপনির্বাচনেরও মুখোমুখি হতে হবে তাকে। এই সময়ে অভ্যন্তরীণভাবে তরী ডুবাতে চাইবেন না তিনি। রবার্টসন বলেন, সরকার, সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক বিরুদ্ধতা নিয়ে এই কমিশনের কোনও ইতিবাচক নজির প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এই জাতীয় কমিশন সহিংসতার জন্য দায়ী সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে পরিস্কার কোনও সিদ্ধান্ত না নেবেন ততক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই তদন্তকে পাত্তা দেবে না।
রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী সাম নাইম বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারে থেকে যাওয়া অসংখ্য রোহিঙ্গাদের জানার অধিকার রয়েছে কারা তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। তাদের জানার অধিকার রয়েছে, কীভাবে এইসব নিপীড়ন সম্পন্ন করা সম্ভব হলো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা কমিশন নিয়ে হতাশ, আমরা সমাধান চাই। সরকার শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সময় নিতে চায়। সত্যিই যদি তারা সমস্যার সমাধান চায় তাহলে তাদের উচিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, রোহিঙ্গাদের কেড়ে নেওয়া নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া আর শর্তহীনভাবে তাদের ফিরতে দেওয়া।’

পাঠকের মতামত