প্রকাশিত: ২১/১০/২০১৮ ৮:০৬ এএম

বালিতে সম্প্রতি শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রাপ্তিতে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য অর্থ ঋণে নয়, অনুদান হিসেবে পাওয়া। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এ ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য দেশগুলোর প্রতি জোরালো আবেদন জানান। এতে সাড়া দিয়ে আরব আমিরাতসহ চারটি দেশ আগামী দু’বছরের জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অপর প্রাপ্তি হচ্ছে রের্কড পরিমাণ ঋণ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি। আগামী একবছরে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈঠকে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, খেলাপি ঋণ ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থেকে সতর্ক করা হয়।

বৈঠক প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, আগামী বছরের জন্য আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার চেয়েছি, তারা ইতিমধ্যে দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি ডলার) দিতে রাজি হয়েছে।

ঋণ সুবিধায় রেকর্ড : বিশ্বব্যাংক ২০১৭-২০১৯ সাল পর্যন্ত এই তিন বছরে বাংলাদেশের জন্য ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। বাংলাদেশ এ অর্থ ২০১৮ সালের মধ্যেই ব্যবহার করে ফেলছে।

অর্থাৎ দু’বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তার পুরোটাই ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বৈঠক হয় বালির নুসাদুয়া কনভেনশন সেন্টারে। সেখানে ২০১৯ সালের জন্য আরও ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়। সেখানে বলা হয় বাংলাদেশের হাতে বর্তমান ৪০০ কোটি ডলারের কর্মসূচি রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি ডলার সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব শফিকুল আজম। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার বাইরে অতিরিক্ত এ অর্থ আফ্রিকা জোন থেকে এনে বাংলাদেশকে দেবে এমন আশ্বাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

রোহিঙ্গা সহায়তা : বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেছে। জার্মানি, কুয়েত, আরব আমিরাত ও সুইডেনকে সহায়তার অর্থ বাংলাদেশকে অনুদান হিসেবে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। তার এই সুপারিশ আমলে নিয়ে চারটি দেশ তাদের সহায়তাকে অনুদান হিসেবে বাংলদেশে দিতে যাচ্ছে। আগামী দুই বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য ১০০ কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে। এটি ঋণ হিসেবে নয়, পুরোটাই অনুদানের ব্যবস্থা করছেন জিম ইয়ং কিম। রোহিঙ্গাদের জন্য এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি সই হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরও ২০ কোটি ডলারের চুক্তি হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবির) সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে ১০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে। আরও ১০ কোটি ডলারের চুক্তি হবে শিগগিরই।

খেলাপি ও আমদানি ব্যয় নিয়ে আইএমএফের প্রশ্ন : বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অর্থনীতিকে দুর্বল করছে বলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সম্প্রতি আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরবর্তী সরকারের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করছি। আমি যাওয়ার আগে এটি দিয়ে যাব।

অন্যান্য সুবিধা : বৈঠকে মাল্টি ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটি সংস্থার কাছে পাবলিক প্রাইভেট পাটর্নারশিপ (পিপিপি) ৪২টি প্রকল্পের অনুকূলে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের কথা তুলে ধরা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) যুক্তরাষ্ট্রে মেট্রোপলিটন টান্সপোর্ট অথরিটির আলোকে ঢাকায় কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। জানা গেছে বর্তমান বাংলাদেশে আইএফসি বছরে ৫০ কোটি ডলার অর্থায়ন করছে। আগামীতে ১০০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ঝুঁকির আশঙ্কা : বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলো বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি ও সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বৈঠকে। এতে বলা হয়, বিশ্বে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন অন্য দিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বার্ণিজ্যযুদ্ধ। এ দুই কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে এ অঞ্চলের দেশগুলো। পাশাপাশি মার্কিন ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের সুদেরহার এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ছে। সার্বিকভাবে এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের টালমাটাল অবস্থা তৈরি হচ্ছে। যে কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ছোট দেশগুলো।

গত ১৪ অক্টোবর বালির নুসাদুয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলন শেষ হয়। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং সরকারি বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি মিলে প্রায় ১৫ হাজার অতিথি এ বৈঠকে অংশ নিয়েছিল। সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যালোচনা করে নেতারা এক মত হয়েছেন, এ মুহূর্তে বিশ্বের দেশগুলোতে স্থিতিশীল রয়েছে অর্থনীতি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ছে। এর সঙ্গে নতুন করে দেখা দিয়েছে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ। সব মিলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এ সংকট থেকে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলো বাদ পড়বে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

পাঠকের মতামত