প্রকাশিত: ০৬/০৮/২০১৮ ৭:১৬ পিএম , আপডেট: ১৬/০৮/২০১৮ ১১:৪৩ পিএম

আন্তর্জাতিক ডেস্ক::
প্রবল বর্ষণের কারণে সৃষ্ট ভূমিধস ও বন্যার হাত থেকে সুরক্ষিত করতে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের অন্য কোনও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এউচআরডাব্লিউ)। সোমবার ‘বাংলাদেশ ইজ নট মাই কান্ট্রি: দ্য প্লাইট অব রোহিঙ্গা রিফিউজিস ফ্রম মিয়ানমার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারে প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের বিষয়েও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে সংস্থাটি। কুতুপালং-বালুখালি আশ্রয়কেন্দ্রের ঘনবসতি বেশি হওয়ার কথা উল্লেখ করে এইচআরডাব্লিউ রোহিঙ্গাদের কম ঘনবসতির ছোট ছোট শিবিরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। তাছাড়া স্থানান্তরের ক্ষেত্রে তারা ভাসান চরের বদলে উখিয়ারই অন্যস্থান বেছে নেওয়ার পক্ষে। তাদের পরামর্শ ছোট ছোট আশ্রয় শিবির বানানোর। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা লিখেছে, বাংলাদেশ সরকার ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েই স্থির রয়েছে এখনও। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরের বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার যে পরামর্শ এইচআরডাব্লিউ দিয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। মানবাধিকার সংগঠনের স্যাটেলাইট ইমেজ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন আর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয়েছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে অনেককে। এমন বাস্তবতায় নিধনযজ্ঞের বলি হয়ে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। আগে থেকে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ।

কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং-বালুখালি এলাকায় রোহিঙ্গাদের বিশাল বড় আশ্রয় শিবিরটি অবস্থিত। এটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবির। স্থানটিকে জনসংখ্যার দিক দিয়ে খুব বেশি ঘনত্বের স্থান আখ্যা দিয়ে এইচআরডাব্লিউ বলেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে মাথাপিছু ১০.৭ বর্গ মিটার স্থান রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মাথাপিছু ৪৫ বর্গ মিটার স্থান থাকার নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে ছয় লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আশ্রয়কেন্দ্রটিতে ছোঁয়াচে রোগ, অগ্নিকাণ্ড, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও যৌন সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলো প্রবল বর্ষণের কারণে ভূমিধসের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের মধ্যে বসবাসের জন্য তাদের অস্থায়ী ঘরগুলোও যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। তাছাড়া প্রবল বর্ষণের কারণে এলাকাটি বন্যার ঝুঁকিতেও আছে। সংস্থাটি আরও মনে করে, উখিয়ার বন্যা ও ভূমিধসমুক্ত, সমতল ও কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত ছোট ছোট আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়া উচিত। তাছাড়া তারা যতদিন মিয়ানমারে ফেরত যেতে না পারছে ততদিনের জন্য তাদের আরও মজবুত ঘর ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালযয়ের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এতে কোনও সন্দেহ নেই যে আশ্রয় শিবিরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। কিন্তু আমাদেরও জমির সংকট আছে। আমাদের নিজেদের দেশের জনসংখ্যাই ১৬ কোটি। রোহিঙ্গাদের যে একবারে একটা স্থানে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে সেটাই তো অনেক বড় বিষয়।’উখিয়া নিউজ ডটকম।

আল জাজিরা লিখেছে, ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে খুব দ্রুত ভাসান চরে স্থানান্তরিত করতে চায় বাংলাদেশ সরকার। ভাসান চর এখনও জনমানবহীন একটি দ্বীপ। এইচআরডাব্লুয়ের মতে, প্রবল স্রোত ও বড় বড় ঢেউয়ের কারণে ওই স্থানটি বসবাসের অনুপোযুক্ত। ঘূর্ণিঝড় হলে দ্বীপটির পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যাবে। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ‘ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের’ সমন্বয়ক নে সান লিন বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও ভাসান চরে যেতে অনিচ্ছুক। সবচেয়ে ভালো হয় যদি তদের উখিয়ার অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে থেকে তারা সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে।’

এইচআরডব্লিউ মনে করে, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য উখিয়াতেই উপযুক্ত স্থান আছে। স্থানটি কুতুপালং-বালুখালি আশ্রয় শিবির থেকে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানে এক সঙ্গে ২ লাখ ৬৩ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেছেন, সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়েই মনস্থির করে রেখেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে।

সংস্থাটির শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তাদেরকে শিবিরের বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে।’ তার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে নে সান লিন বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তা তাদের অবস্থার উন্নতিতে অনেক বেশি সহায়ক হবে; আশ্রয় শিবিরগুলোর অবস্থাও উন্নত হবে।’

রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্ব পালন করা স্থানীয় সাংবাদিক তারেক মাহমুদ মনে করেন, রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু রোহিঙ্গাদের শিবিরের বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিতের সুযোগ দিলে তা স্থানীয় জনগণের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করবে। তার চেয়ে আশ্রয় শিবিরেই তাদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা শ্রেয়, যাতে মিয়ানমারে ফেরত গিয়ে তারা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুবিধা পায়।

এইচআরডাব্লিউয়ের বিল ফ্রেলিক রোহিঙ্গা সংকটের জন্য মিয়ানমারকে দায়ী করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তার ভূমিকার জন্য যথার্থভাবেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়েছে। তার ভাষ্য, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের ব্যর্থ হওয়া, যুগের পর যুগ তাদের বঞ্চিত করা ও জনগোষ্ঠীটিকে নিপীড়নের শিকার হতে বাধ্য করার মতো ঘটনার কারণেই রোহিঙ্গারা এখনও তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছে না।’

পাঠকের মতামত